মাহবুবুল হক শাকিল। একজন রাজনীতিবিদ ও কবি। বর্তমানে উভয় মাধ্যমে সমানভাবে সরব তিনি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি শাকিল অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সচিব এবং আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআরআই’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদেও দায়িত্ব পালন করছেন।
এবারের বইমেলায় মাহবুবুল হক শাকিলের দ্বিতীয় কবিতার বই ‘মন খারাপের গাড়ি’ প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে গত বছর বইমেলায় প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতার বই ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’। প্রকাশিতব্য বই, কবিতা যাপন, রাজনীতি ও কবিতার পৃথক দুটি গণ্ডিতে নিজের ভারসাম্য স্থাপনসহ নানা বিষয়ে শনিবার বিবার্তার সাথে কথা বলেছেন তিনি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহনেওয়াজ সুমন। ছবি তুলেছেন মোর্শেদুর রহমান।
বিবার্তা: প্রকাশিত বইটি সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন
মাহবুবুল হক শাকিল: আমি আসলে কবিতা লিখি না। কবিতার মধ্যে নিজের সঙ্গেই কথা বলেছি। এক সময় মনে হয়েছে, এগুলো প্রকাশ করার দরকার। সে আবেগ থেকেই বই প্রকাশ। এগুলো কতটা কবিতা হয়ে উঠেছে জানি না। পাঠকই এর মূল্যায়ন করবেন। আমার ব্যক্তিগত চিন্তা অন্যের ভালো লাগলেই বই প্রকাশ স্বার্থকতায় রূপ নেবে।
বিবার্তা: কবির বাইরেও আপনার বড় পরিচয় রাজনীতিক। একসাথে এ দুই পরিচয়ের ভারসাম্য রক্ষা করেন কিভাবে?
মাহবুবুল হক শাকিল: আমার মনে হয় কবি পরিচয় বা রাজনৈতিক কর্মী পরিচয়ের মধ্যে খুব একটা ভেদরেখা নেই। রাজনীতি যেমন একটি শিল্প, কবিতাও তেমনি একটি শিল্প। এবং কবিতা যদি হয় ব্যক্তিগত স্বপ্নের নির্মাণ, রাজনীতি হলো একটি সামগ্রিক বা সামষ্টিক স্বপ্নের নির্মাণ। স্বপ্নের সঙ্গে স্বপ্নের যেমন কোনো সংঘাত হয় না, কবি পরিচয়ের সঙ্গেও রাজনৈতিক পরিচয়ের কোনো সংঘাত হয় না।
বিবার্তা: কবিতায় শুধু ব্যক্তিগত স্বপ্নেরই নির্মাণ কেন, কবিতায় কি সামষ্টিক বা সামগ্রিক স্বপ্নের নির্মাণ হয় না?
মাহবুবুল হক শাকিল: আমি মনে করি কবিতা কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার না। আমি যদি আরেকটু খোলামেলা বলি, কবিতা হলো একধরনের দুঃখবোধ, আবেগ, প্রেম, অপ্রেম, বিরহ, চাওয়া, না পাওয়া, এই সমস্ত বিষয়গুলোর একটি সম্মিলিত যোগফল।
বিবার্তা: এটা কি তাহলে আপনার একটা পছন্দ। কারণ আমরা তো কবিতাকে আরো অনেক ধরনের দায়বদ্ধতা পূরণ করতেও দেখি।
মাহবুবুল হক শাকিল: কবিতা অবশ্যই রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা পূরণ করে। অবশ্যই যে শামসুর রাহমান প্রেমের কবিতা লেখেন, তিনিই আবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও কবিতা লেখেন, যে নির্মলেন্দু গুণ অমীমাংসিত রমণী খোঁজেন, সে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবের নামের ওপর কাঁদেন তার কবিতায়। এখানে কবিতা শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়, আমি যে কথাটি বলতে চেয়েছি যে, কবিতা কখনো রাজনৈতিক স্লোগান নয়। মোটকথা রাজনীতি যখন একটি সর্বোচ্চ মার্গে পৌঁছায়, রাজনৈতিক কবিতাও তখন একটি শিল্পিত জায়গায় পৌঁছায়।
বিবার্তা: রাজনৈতিক অনুসারীরা আপনার কবি পরিচয় নিয়ে মাতামাতি করবে এটা স্বাভাবিক, জানতে চাইছি কবি লেখক মহল আপনার রাজনৈতিক পরিচয়টাকে কিভাবে নেয়?
মাহবুবুল হক শাকিল: আমার মনে হয়েছে আমার কবিতার যে অডিয়েন্স, তারা আমার রাজনৈতিক পরিচয়কে ভুলে গিয়েই, হয়তো কারণে অকারণেই আমার কবিতাকে ভালোবাসেন। আমার কবিতা পড়েন। এবং কবি হিসেবে অবশ্যই তখন আমি ধন্য হই।
বিবার্তা: আপনার কবিতা লিখার শুরুর সময়টা জানতে চাইছি। কাদের কবিতা আপনাকে অনুপ্রাণিত করত?
মাহবুবুল হক শাকিল: লিখতে শুরু করার সময় বলতে.. লিখি ছোটবেলা থেকেই। ছোটবেলা বলতে স্কুল থেকেই। কিন্তু লেখা প্রকাশের বা ছাপানোর স্পর্ধা পাইনি। একসময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি কবিতা লিখেছিলাম, সেটিই আমার প্রথম মুদ্রিত কবিতা। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। তারপর দীর্ঘদিন বিরতি। কবিতা লিখতাম, কিন্তু সমস্ত কবিতাই আশ্রয় পেত আমার নিজস্ব শিয়রের নিচে।
বিবার্তা: এটা কি নিজের অসন্তুষ্টিজনিত কারণে?
মাহবুবুল হক শাকিল: ঠিক তা নয়। একধরনের পীড়াবোধ.. সংকোচ।
বিবার্তা: এই বিরতির পর আবার কবে কিভাবে প্রকাশ করতে লাগলেন।
মাহবুবুল হক শাকিল: আমাদের প্রজন্ম যারা, আমরা কিন্তু ফেসবুক প্রজন্ম ছিলাম না। বা আমরা ইন্টারনেট প্রজন্ম না। এবং অতি অবশ্যই ফেসবুকে যখন এলাম, মাঝেমধ্যে মনে হলো যেসব কবিতা আমার শিয়রে থাকে, আমার দেরাজে থাকে, সেগুলো ফেসবুকেও থাকুক না! মন্দ কী? তারপর একসময় অনুরুদ্ধ হলাম বিশেষ একজনের দ্বারা, কবিতার বই প্রকাশের জন্য। এবং তারই ফলশ্রুতিতে গতবার প্রথম কবিতার বই প্রকাশ।
বিবার্তা: কবিদের একটা দশক ভিত্তিক পরিচয় থাকে যে অমুক আশির দশকের কবি তো তমুক নব্বইয়ের দশকের। সেই বিবেচনায় আপনাকে কোন দশকের কবি বলা যায়?
মাহবুবুল হক শাকিল: আমি দশক ভিত্তিক কবি বিচার কখনোই সমর্থন করি না। এবং যৌক্তিক মনে করি না। পাঠক যদি এখনো মোহিতলাল মজুমদারের কবিতা পড়ে মোহিত হন, তাহলে আপনি তাকে কোন দশকের কবি বলবেন? পাঠক যদি এখনো জসীম উদ্দীনের কবিতা পড়েন, বাংলা ভাষার পাঠকমাত্রই এখনো বিনয় মজুমদারের কবিতা পড়েন, এটা ২০১৬, বিনয়কে কোন দশকের কবি বলবেন?
বিবার্তা: কবি লেখকদের মধ্যে আপনার বন্ধুবান্ধব কারা, একদম যাদের সঙ্গে কবিতা নিয়েই আড্ডা দিতে বসেন?
মাহবুবুল হক শাকিল: ব্যস্ততার কারণে এই সৌভাগ্য আমার খুব কম হয়ে থাকে। তারপরও নিজেকে আমি খুব সৌভাগ্যমান মনে করি, বাংলাদেশের কবি লেখকদের মধ্যে অনেকেই আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। কেউ আমার বয়সে বড়, সমসাময়িক বা অনেকে ছোট-কিন্তু একটি জায়গায় সবার বয়স এক হয়ে যায়, কবিতায়। সেক্ষেত্রে অবশ্যই যার কথা বলতে হয়, দীর্ঘদিন আমরা একসাথে আড্ডা দিয়েছি, আপাদমস্তক কবি হিসেবে যাকে বোঝায়—কবি রফিক আজাদ, প্রয়াত কবি সিকদার আমিনুল হক, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, শিহাব সরকার, জাহিদুল হক। আমাদের সমসাময়িকদের মধ্যে সরকার আমিন, শাহনাজ মুন্নী, মুজিব ইরম, শোয়াইব জিবরান। তার কাছাকাছি সময়ে তানিম কবির, ওবায়েদ আকাশ। এবং, আমার রাজনৈতিক চিন্তা বা কাব্যভাষা নির্মাণের চিন্তাতেও ঠিক বিপরীত মেরুতে যার অবস্থান—ব্রাত্য রাইসু।
বিবার্তা: আপনার প্রিয় কবি কারা?
মাহবুবুল হক শাকিল: বাঙালি মানেই রবীন্দ্রনাথ শিখে বড় হয়। আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আর বিনয়, বিনয় এবং বিনয় (মজুমদার)।
বিবার্তা: আপনাকে ধন্যবাদ
মাহবুবুল হক শাকিল: আপনাকে ও বিবার্তাকে ধন্যবাদ।
বিবার্তা//সুমন//মাজহার