‘সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা হবে সেরা প্রোগ্রামার’

‘সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা হবে সেরা প্রোগ্রামার’
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১৯:৫১:০৯
‘সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা হবে সেরা প্রোগ্রামার’
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+
উন্নত বিশ্বে রয়েছে অনেক শিশু-কিশোর প্রোগ্রামার। তারা তৈরি করছে নানা ধরনের গেম সফটওয়্যার। বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের মধ্যেও রয়েছে প্রোগ্রামার হয়ে ওঠার মতো প্রতিভা। রয়েছে অনেক সম্ভাবনা। 
 
এ সম্ভাবনা নিয়েই কাজ করার জন্য শুরু হয় ‘কিডস গো কোডিং’ প্রকল্পের যাত্রা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের কম সুবিধাপ্রাপ্ত স্কুলপড়ুয়া শিশুদের কোডিং শেখানো হয়। এই উদ্যোগটির কো-ফাউন্ডার উম্মে শারমিন কবীর। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করে বর্তমানে তার এই উদ্যোগটি নিয়ে কাজ করছেন।
 
শনিবার বিকেলে রাজধনীর গুলশান-২ এ ‘কিডস গো কোডিং’-এর প্রধান কার্যালয়ে সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোরদের নানা আভিজ্ঞতার বিষয়ে তিনি কথা বলেন বিবার্তা২৪.নেটের নিজস্ব প্রতিবেদকের সাথে। সম্ভাবনাময় শিশু-কিশোরদের ছোট ছোট স্বপ্নের কথা  নিয়ে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন উজ্জ্বল এ গমেজ।
 
বিবার্তা২৪.নেট:  ‘কিডস গো কোডিং’-এর শুরুর গল্পটা বলবেন?
 
শারমিন কবীর:  কিডস গো কোডিংয়ের মতো কিছু একটা করার ইচ্ছেটা আসলে বহু বছরের। এটি বেটার স্টোরিজ লিমিডেটের একটি সামাজিক উদ্যোগ। ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাংক ও মাইক্রোসফট আয়োজিত একটি প্রতিযোগিতায় কিডস গো কোডিংয়ের অন্য দু’জন কো-ফাউন্ডার এবং বেটার স্টোরিজ লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মিনহাজ আনওয়ার ও সিইও মোহাইমিন খান এই আইডিয়াটা নিয়ে অংশগ্রহণ করেন।
 
সেদিন তরা পুরস্কার হিসেবে জেতেন ১০ হাজার ডলার। ২০১৫ সালে কিডস গো কোডিংয়ে কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এর পৃষ্ঠপোষক মাইক্রোসফট বাংলাদেশ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক।
 
বিবার্তা২৪.নেট: কিডস গো কোডিংয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী?
‘সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা হবে সেরা প্রোগ্রামার’
শারমিন কবীর: কিডস গো কোডিংয়ের সার্বিক উদ্দেশ্য বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের কোডিং/কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ শেখানোর মাধ্যমে তাদেরকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা। বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো করে প্রস্তুত করা। 
 
তবে প্রথম লক্ষ্য হলো আমাদের সমাজের অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাপ্রাপ্ত স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের কোডিং শেখানোর মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা। তারা এ কোর্সের মাধ্যমে কম্পিউটারের প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ শিখে ভবিষ্যতে বড় ধরনের কিছু করতে পারবে। এতে একদিকে যেমন তাদের স্কুল ড্রপআউট কমবে, অন্যদিকে নিজেদের ভেতর একটা ভালো কিছু করার তাগিদও তৈরি হবে। 
 
যারা এখানে প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ শিখবে তারা বিভিন্ন সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিতে ও অ্যাপ ডেভেলপারদের সাথে কাজ করার সুযোগ পাবে। সেখানে তাদের আরো শেখার সুযোগ থাকবে। ফলে তারা হাতে-কলমে কাজ শিখে একদিন ভালো বেতনে কাজ করতে পারবে। নতুন কিছু করতে পারবে।
 
কিডস গো কোডিংয়ের মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষা এইসব ছেলেমেয়ে বিভিন্ন উপার্জনক্ষম কাজে লাগিয়ে পরিবারকে আর্থিকভাবে সাপোর্ট দিতে পারবে। সর্বোপরি, কোডিং শিক্ষাকে পুঁজি করে সমাজে তারা নিজেদের একটা পরিচয় সৃষ্টির মাধ্যমে একদিন পুরো বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট পাল্টে দেবে-এটাই কিডস গো কোডিংয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
 
বিবার্তা২৪.নেট: এই আইডিটার প্রেক্ষাপট জানতে চাই।
 
শারমিন কবীর: আমাদের দেশের প্রায় ৪.৮ মিলিয়ন কিশোর-কিশোরী ‘বটম অব দ্য পিরামিড’-এ (বিওপি) বাস করে। তারা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রতিদিন তাদের পেছনে এক ডলারেরও কম খরচ হয়। যদিও পিতা-মাতারা এসব কিশোর-কিশোরীদের স্কুলে পাঠায়, কিন্তু যখন তাদের বয়স ১৩-১৫ হয় তখন তাদের মা-বাবার অনেকেই মনে করেন এখন তাদের দিয়ে পরিবারে আয় করানো সম্ভব। 
 
তাদের দিয়ে গার্মেন্টসে কাজ করায় অথবা এ ধরনের বিভিন্ন কাজে পাঠায়। এভাবে এসব কর্মরত ছেলেমেয়েদের আর পড়ালেখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ছোট থেকেই তারা শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করে।
 
‘কিডস গো কোডিং’ প্রকল্পের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষা দিলে তারা আর আগের মতো জীবনযাপন করবে না। বস্তিতে তারা যেভাবে থাকতো আস্তে আস্তে তাদের সব বদলে যাবে। তাদের পেশা, পারিবারিক অবস্থা, সামাজিক মর্যাদা সবই একটু একটু করে পরিবর্তন হতে থাকবে। 
 
যে ছেলেটে হয়তো বড় হয়ে তার বাবার পেশায় নিয়োজিত হতো। যেমন রিকশা চালানো, যে মেয়েটি গার্মেন্টেসে কাজ করতো, সে ছেলে বা মেয়েটা কিডস গো কোডিংয়ের মাধ্যমে তাদের সমস্ত জীবনটাই বদলে দিতে পারে। এভাবে সমাজে তাদের পরিচয় নিজেরাই তৈরি করতে পারবে। সামাজে তাদের একটা ঠিকানা হবে।
 
বিবার্তা২৪.নেট: কিডস গো কোডিংয়ের প্রোগ্রাম পরিচালনা করছেন কোথায়?
‘সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা হবে সেরা প্রোগ্রামার’
শারমিন কবীর: শুরু থেকে আমরা ২টা স্কুলে এ প্রোগ্রাম পরিচালনা করছি। একটা জাগো ফাউন্ডেশনে আর আরেকটা হচ্ছে মিরপুর সোহাগ স্বপ্নধারা পাঠশালায়। দুটোতেই রয়েছে পর্যাপ্ত কম্পিউটার ও ল্যাপটপ। এগুলো ব্যবহার করে তারা শিখতে পারছে। বর্তমানে আমাদের ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ১০০।
 
বিবার্তা২৪.নেট: এখানে কী কী শেখানো হয়?
 
শারমিন কবীর: আমরা প্রথমে কম্পিউটার বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা দেই। মাইক্রোসফট স্মল বেসিক প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজের ১৪টা বিষয় নিয়ে একটা কারিকুলাম তৈরি করেছি। এ কারিকুলাটি মাইক্রোসফট ও দিমিক কম্পিউটিং স্কুলের যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরী। 
 
একটি ভাষা শিখতে হলে যেমন প্রথমে এর বর্ণ ও অক্ষর শিখতে হয়, ঠিক তেমনি প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ শিখতে গেলেও এর সিনটেক্স জানতে হয়। যা মাইক্রোসফট স্মল বেসিক প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে আসছি।
 
বিবার্তা২৪.নেট: যারা এখন কোডিং শিখছে, এখান থেকে পাস করে বেরোনোর পরে তাদের নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
 
শারমিন কবীর: যারা আমাদের এখানে কোডিং শিখছে, তাদেরকে বিভিন্ন সফটওয়্যার কোম্পানিতে ও অ্যাপ ডেভেলপার কোম্পানিতে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করার সুযোগ করে দেব। ভালো ভালো সফটওয়্যার কোম্পিানিতে কাজ করার সুযোগ করে দিলে তারা নিজেদের আরো ঝালাই করে নেয়ার সুযোগ পাবে। আমার বিশ্বাস, একদিন এরাই নিজেদের কোম্পানি খুলবে। এরাই অন্য মানুষদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে সক্ষম হবে।
 
বিবার্তা২৪.নেট: কিডস গো কোডিংয়ের প্রশিক্ষক হিসেবে কারা কাজ করছেন?
 
শারমিন কবীর: এখানে প্রশিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির ছাত্র/ছাত্রী আছেন। যারা বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে এসব বিষয়ে পড়াশুনা করছেন বা গবেষণা করছেন। এছাড়াও প্রফেশনাল ট্রেইনারও আছেন বেশ কয়েকজন।
‘সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা হবে সেরা প্রোগ্রামার’
বিবার্তা২৪.নেট: আপনি তো এ প্রোগ্রামের সাথে শুরু থেকে আছেন। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
 
শারমিন কবীর: ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। একটা সাফল্যের ঘটনা বললে বিষয়টা আরো পরিস্কার হবে। মিরপুর স্কুলে সুজন নামে একটা ছাত্র পড়ে। আমরা তাকে কম্পিউটার বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছি মাত্র। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, মাইক্রোসফট পাওয়ার পয়েন্ট ও এক্সেল এসব শেখানোর পর সে আমাদের সবাইকে অবাক করে তার স্কুলের অফিসিয়াল কাজ করা শুরু করেছে। 
 
স্কুল কর্তৃপক্ষ আগে এই কাজগুলো হাতে লিখে বাইরে গিয়ে কম্পিউটারে কম্পোজ করে আনতো। বাইরে যেগুলো অনেক টাকা দিয়ে করে আনতে হতো, সেই কাজগুলো এখন সুজন-এ স্কুলের জন্য করে দিচ্ছে। ফলে বাইরে কাজ করালে যে টাকা দিতে হতো সে টাকা ‍এখন সুজনকে দেয়া হচ্ছে। এখন সে কোডিং শিখছে আবার স্কুল ছুটির পর স্কুলের কাজগুলো করে টাকাও আয় করছে।
 
আরেকটা মেয়ের কথা শেয়ার করতি চাই। জাগো ফাউন্ডেশনের একজন মেয়েকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি কী হতে চাও? সে উত্তর দিল, আমি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই। কিন্তু ডাক্তাররা অনেক ব্যস্ত থাকে। ডাক্তার হলে আমি আমার মাকে ওইভাবে সাহায্য করতে পারব না। তাই আমি কোডিং শিখে একটা রোবোট বানাবো। যে রোবোট আমার মায়ের কাজে সাহায্য করতে পারবে।
 
বিবার্তা২৪.নেট: আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
 
শারমিন কবীর: আপনাকে এবং বিবার্তা২৪.নেটকেও অনেক ধন্যবাদ।
 
বিবার্তা/উজ্জল/কাফী
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com