এসএ গেমসের ভারোত্তোলনে প্রথম স্বর্ণপদক জিতেছে বাংলাদেশ। ভারতের আসামের গোয়াহাটির ভোজেশ্বরী ফুগনোনি ইনডোর স্টেডিয়ামে ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে দেশকে এই সাফল্য এনে দিয়েছেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত।
অনেকেই তাকে এখন স্বর্ণকন্যা বলে ডাকেন। বৃহস্পতিবার সন্ধায় জাতীয় ক্রিড়া পরিষদে (এনইসি) মাবিয়া আক্তার সীমান্তের সঙ্গে কথা হয় বিবার্তা প্রতিবেদকের। আলাপচারিতায় বেরিয়ে নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তার সাফল্য যাত্রার কথা। সেই আলাপচারিতার চুম্বক অংশ বিবার্তার পাঠকের জন্য তার চুম্বক তুলে ধরা হলো-
বিবার্তা: কেমন আছেন?
মাবিয়া: খুব ভালো আছি।
বিবার্তা: খেলার জগতে আসা প্রসঙ্গে কিছু বলুন...।
মাবিয়া: ছোটবেলা থেকে মামাকে (কাজী শাহাদত হোসেন। জাতীয় বক্সিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক) খেলতে দেখতাম। এছাড়াও মামা আমাকে খেলোয়াড় হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন। মামা যদি উৎসাহিত না করতেন, আমি কোনোদিন খেলার জগতে আসতাম না। মামার উৎসাহেই আজ এ পর্যন্ত এসেছি।
বিবার্তা: খেলার জগতে আসার পর কোনো বাধা-বিপত্তির মুখে পড়েছেন কী?
মাবিয়া: মেয়েরা খেলোয়াড় হোক, এটা সমাজের অনেকেই চায় না। আমার বাবাকে অনেকে খেলোয়াড় বানাতে নিষেধ করেছেন। তারা বাবাকে বলেছেন খেলোয়াড় হবে পুরুষরা। তোমার মেয়েকে ওই পথ থেকে ফিরিয়ে আনো।
বাবা তাদের কথা মতো আমাকে খেলোয়াড় না হয়ে অন্য কিছু হতে বলেছেন। আমাদের প্রতিবেশী থেকে শুরু করে অধিকাংশ মানুষ একই কথা বলতেন। কিন্তু আমার দৃঢ় মনোবলের কারণে সব বাধা অতিক্রম করতে পেরেছি।
বিবার্তা: বিভিন্ন খেলা থাকতে কেন ভারোত্তোলনের মতো একটা কঠিন খেলাকে বেছে নিলেন?
মাবিয়া: আমার মামার বন্ধু জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের ওয়েটলিফটিংযের কোচ ফারুক সরকার (কাজল) স্যার। তার ও মামার প্রেরণায় এ খেলাকে ভালোবেসে ফেলি। তারা আমাকে এমনভাবে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, জীবন বাজি রেখে অনুশীলন শরু করি। তারা বলেছেন, তুমি একদিন সফল হবে। তাদের কথাই সত্যি হলো।
বিবার্তা: আপনার সাফল্যের পেছনের রহস্য কী?
মাবিয়া আক্তার সীমান্ত: ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। পাশাপাশি চেষ্টা করতে হয়। আমি দুটি বিষয়কে সামনে রেখে চেষ্টা করেছি। আমি বলবো, ইচ্ছে থাকলে সব বাধা অতিক্রম করে সফল হওয়া যায়। আল্লাহ আমার স্বপ্ন পূরণ করেছে।
বিবার্তা: পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে বলুন।
মাবিয়া: রাজধানীর খিলগাঁও সিপাহীবাগ বাজার সংলগ্ন ঝিলের ওপর তৈরি ঝুপড়ি ঘরে আমিসহ আমার পরিবার থাকে। ২৫০- থেকে ৩শ’ গজ বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে ঘরটিতে যেতে হয়। ঘরের নিচে মলমূত্র আর কালো দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানি।
ঘরের মধ্যে বসে দেখা যায় না কখন সূর্য ওঠে, কখন অস্ত যায়। ঘরে মাত্র একটি জানালা। ঘরে বাতাস প্রবেশ করে না। খুব কষ্ট করে আমার বাবা সংসার চালান। আমার বাবা দোকানে কাজ করে খুব কষ্ট করে আমাদের বড় করেছেন। মা গৃহিনী। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের আবাসনের আশ্বাস দিয়েছেন। আবাসনের ব্যবস্থা হয়ে গেলে পরিবার নিয়ে ভালো ভাবে থাকতে পারবো।
বিবার্তা: আর্থিক অসচ্ছলতা সত্বেও কীভাবে প্রাকটিস চালিয়ে গেলেন?
স্বর্ণকন্যা মাবিয়া: আমার স্যারেরা বলেছেন জয়ী তোমাকে হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এ কথা মাথায় রেখে অনেক দিন ভোরে দুটি রুটি খেয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে প্র্যাকটিস করতে এসেছি। সন্ধ্যা পর্যন্ত প্র্যাকটিস করে না খেয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় যেতাম। ক্ষুধা লাগলে শুধু পানি খেতাম।
অনেক সময় বাসায় ফিরে দেখতাম ঘরে কোনো রান্না হয়নি। মা-বাবাসহ পরিবারের না খেয়ে আছে। অনেক সময় প্রশিক্ষণ কোচ (স্যার) আমাকে কিছু টাকা দিতেন। তা দিয়ে আটা কিনে সবাই রুটি বানিয়ে খেতাম। আবার অনেক সময় না খেয়ে থাকতাম। তবে আমার এই লড়াইয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান মামা কাজী শাহাদত হোসেনের। তিনি জাতীয় বক্সিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। মামা আমাকে নিয়ে যান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে। সেখানে ভারোত্তলন শাখায় ভর্তি করান। তারপর উন্নতি। একের পর এক ইভেন্টসে সাফল্য পেতে থাকি। আনসারের হয়ে পদক পাওয়ায় আমাকে প্রথমে তিন হাজার পরে পাঁচ হাজার টাকা করে সম্মানী দেয়া হয়।
বিবার্তা: এসএ গেমসসহ আপনার সফলতা সম্পর্কে কিছু বলুন।
মাবিয়া: বিগত বাংলাদেশ গেমস দুটিতে ভারোত্তলনে স্বর্ণপদক পাই। তারপর নেপাল, ভারত, মালয়েশিয়া, কাতার, থাইল্যান্ডে একের পর এক শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রাখি। গত সাত ফেব্রুয়ারি অাসামের গোয়াহাটিতে এসএ গেমসে ভারোত্তলনে স্বর্ণপদক পেয়েছি।
বিবার্তা: দেশের জন্য এমন একটি জয় পাওয়ার আপনার কেমন লাগছে?
মাবিয়া: দেশে ফিরে আসার পর শত শত ফোন পেয়েছি। সবাই আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আমাকে অনেকে সম্মান জানিয়েছেন। যখন আমি গোয়াহাটিতে স্বর্ণ জয় করলাম তখন মনে হয়েছিল এটি আমার জয় করার কথা ছিলো।
তবে দেশে এসে মানুষ যে ভাবে ভালোবাসা দিলো তখন অনুভব করলাম স্বর্ণটি শুধু আমার পাওয়া কথা ছিলো না, এটি দেশবাসীর পাওয়ার স্বপ্ন ছিল। দেশের জন্য কিছু করতে পারায় নিজেকে গর্বিত নাগরিক মনে হচ্ছে।
বিবার্তা: ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু বলুন।
মাবিয়া: আগামী এপ্রিল মাসে পাকিস্তানে আরেকটি গেমস অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন হতে পারলেই অলিম্পিক খেলতে পারবো। আর এ টার্গেট নিয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছি। কিন্তু আর্থিক অচ্ছলতার কারণে সমস্যা হচ্ছে।
আমার মা-বাবা, ভাই-বোনের দুঃখ-কষ্ট আমাকে দেখতে হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের থাকা-খাওয়া নিশ্চিত করতে পারলে আরো ভালোভাবে প্র্যাকটিস করতে পারতাম। আর প্র্যাকটিস করতে পারলেই সামনের ইভেন্টসে সাফল্য অর্জন করতে পারবো।
বিবার্তা: যেসব মেয়ে সফল হতে চান, তাদের জন্য কিছু বলুন।
মাবিয়া: সফল হওয়ার পথে অনেক বাধা আসবে। সেসব বাধা অতিক্রম করতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। ভয়কে জয় করতে হবে। তাহলে সবাই একদিন সফল হবেন।
বিবার্তা: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে আছে?
মাবিয়া: প্রধানমন্ত্রী আমাকে দেখা করার সুযোগ দিলে অবশ্যই দেখা করবো। প্রধানমন্ত্রী দরিদ্র ও সফল মানুষদের বুকে নিয়ে আদর করেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার সাক্ষাত হলে আমাকে আদর করবেন। তিনি আমাকে উৎসাহিত করবেন।
বিবার্তা: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মাবিয়া: আমার পক্ষ থেকে বিবার্তা পরিবারের সবাইকেও ধন্যবাদ।
বিবার্তা/বশির/আসাদুজজামান/কাফী