গণমাধ্যমের কল্যাণে বৃক্ষমানব আবুল বাজানদারকে এখন দেশের সবাই চেনেন। খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার বাসিন্দা তিনি।
১০ বছর আগে ‘এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’ রোগে আক্রান্ত হয়ে তার দুই-হাত পায়ে গাছের শেকড়ের মতো বড় বড় মাংসপিণ্ডের সৃষ্টি হয়। তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন বৃক্ষমানব নামে।
এ অবস্থা দেখে এলাকাবাসী ভয়ে কেউ তার কাছে যেতো না। এলাকাবাসী বলতো এটি দুরারোগ্য ছোয়াচে রোগ। যে কাছে যাবে, সেই আক্রান্ত হবে। কেউ তার সাথে না মেশায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন আবুল।
যাকে দেখে এলাকার মানুষ ভয়ে পালাতো, তাকে কেউ ভালোবাসবে, বা বিয়ে করবে এমন আশা কেউ করেনি। কিন্তু ‘বৃক্ষ মানব’ আবুল বাজানদারের অসহায়ত্ব দেখে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন পাশ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দা হালিমা খাতুন।
এর পর তাকে ভালোবাসেন। পরিবারের কথা উপেক্ষা করে কোর্টে গিয়ে বিয়েও করেন। তাই এলাকাবাসী তাকে ‘এ যুগের লাইলী ’ বলে ডাকেন।
বুধবার বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে আবুল বাজানদারের স্ত্রী হালিমা খাতুনের সঙ্গে কথা হয় বিবার্তা প্রতিবেদকের। আলাপচারিতায় উঠে আসে সুঃখ-দুঃখের নানা কাহিনী। সেই আলাপচারিতার চুম্বক অংশ বিবার্তার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
বিবার্তা: কেমন আছেন?
হালিমা: খুব ভালো আছি।
বিবার্তা: আবুল বাজানদারের সঙ্গে পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলুন...
হালিমা: আমাদের গ্রামের বাড়ি পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী গ্রামে। আমার এক বোনের বিয়ে হয়েছে বাতিখালী গ্রামে। আমার বোনের শ্বশুরবাড়ির পাশের বাড়িতে আবুল বাজানদারের বাড়ি।
কৌতুহল বশত একদিন তাকে দেখতে যাই। তাকে দেখে খুব কষ্ট পেয়েছি। এলাকার লোকজন আমাকে বলে এটি ছোয়াচে রোগ, দ্রুত চলে যাও। তোমারও এ রোগ হবে। আমি তাদের কথা উপেক্ষা করে তার হাত ছুয়ে দেখি। মনে মনে বলি আল্লাহ তুমি তাকে কেন এত কঠিন রোগ দিয়েছো। যখন তুমি রোগ দিয়েছো, তাকে দ্রুত সুস্থ করে দাও।
এর পর ধীরে ধীরে তার প্রতি আমার মায়া হয়। বোনের বাড়ি গেলেই তাকে দেখতে যেতাম। এভাবে তাকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলি। কিন্তু প্রকাশ করিনি। মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে অল্প-অল্প কথা বলতাম।
বিবার্তা: বিয়ে প্রসঙ্গে কিছু বলুন...
হালিমা: আবুল বাজানদার আমাকে প্রথমে ভালোবাসার কথা বলে। আমি মুখ ফুটে কিছুই বলিনি। তবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম। আমার বোন এ বিষয়টি টের পেয়ে মা-বাবাকে জানিয়ে দেয়।
মা-বাবা আমাকে বুঝিয়ে বলে- আবুল বাজানদার মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত। সে কোনো দিন সুস্থ হবে না। তারা আমাকে বলে তোর জীবনটা শেষ করে দিস না। আমি মা-বাবাকে বলেছি আমার বিয়ের পর যদি এ রোগ হতো, তখন আমি কি তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারতাম? আর তোমরাও কি তাকে ফেলে দিতে পারতে?
সবার কথা উপেক্ষা করে ২০১১ সালে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করি। এর পর আমার মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৩ সালে আমার মেয়ে জন্মের পর পরিবারের সবাই দেখতে আসে এবং আমাদেরকে নিয়ে যায়। এখন সবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। সবাই আমাকে এখন বলে তুই খুব ভালো কাজ করেছিস।
বিবার্তা: কীভাবে চলতো আপনাদের সংসার...
হালিমা: আমার স্বামী ছোট-খাট কাজ করত পারতো। আমি বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে সংসার চালিয়েছি। এছাড়া বিভিন্ন বাড়িতে পানি দিয়ে, কাথা সেলাই করে যা আয় হতো, তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালিয়েছি। কোন দিন এক পোয়া আটা দিয়ে রুটি বানিয়ে সারা দিন খেয়ে থেকেছি। আল্লাহ যে ভাবে রাখছে তাতেই খুশি। এভাবে বেঁচে থাকলেই খুশি।
বিবার্তা: আপনার স্বামী আবুল বাজানদার সম্পর্কে কিছু বলুন...
তিনি খুব সাদাসিদে মানুষ। কখনও আমার সঙ্গে রাগ করেনি। সব সংসারে একটু-আধটু রাগারাগি হলেও আমাদের মধ্যে ছিল না। তিনি দীর্ঘ ১০ বছর ধরে অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত। শরীরের প্রচণ্ড ব্যাথা করতো। ব্যাথায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কান্নাকাটি করতেন। কিন্তু আমার সঙ্গে কোনো দিন খারাপ আচারণ করেননি। তিনি একজন মহৎ মানুষ।
বিবার্তা: আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন...
হালিমা: আমি এসএসসি পাস করেছি। এস এসসিতে এ মাইনাস পেয়েছিলাম। এরপর কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। অভাবের কারণে লেখা-পড়া করতে পারিনি। স্যারেরা সহযোগিতা করবেন বলেছিলেন; কিন্তু আর লেখাপড়া করা হয়নি।
বিবার্তা: অপারেশনের পর আপনার স্বামীর কী অবস্থা?
হালিমা: স্যারেরা (চিকিৎসক) বলেছেন তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবেন। এখন তিনি ভালো আছেন। আমি এখন সব চেয়ে সুখী মানুষ। আশাকরি আল্লাহ তাকে দ্রুত সুস্থ করে দেবেন।
অপারেশনের পর গতকাল (মঙ্গলবার) ডান হাতে ড্রেসিং করা হয়েছে। ২-৩ দিন পরে আবারও ড্রেসিং করার কথা রয়েছে। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন। তিনি যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেও।
বিবার্তা: সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
হালিমা: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।
উল্লেখ্য, গত ৩০ জানুয়ারি আবুল বাজানদার ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন। ২০ ফেব্রুয়ারি তার ডান হাতের অস্ত্রোপচার হয়েছে। তিনি বর্তমানে সুস্থ আছেন।
আবুল বাজানদার খুলনার পাইকগাছার বাতিখালী গ্রামেরর বাসিন্দা। তার বাবার নাম মানিক বাজানদার। ৮ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ৬ষ্ঠ। তিনি এক কন্যা সন্তানের জনক।
বিবার্তা/ আসাদুজজামান ও বশির/কাফী