গোলাম সারোয়ার মিলন। এক সময়ের রাজপথ কাপানো নেতা। সাবেক মন্ত্রী এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রথম নির্বাচিত (১৯৮১-৮২) সভাপতি। রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসায় রয়েছে তার সুনাম। তিনি বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক, এফবিসিসিআই’র সদস্য। এ ছাড়া তিনি লাইফ স্টাইল এন্ড কোম্পানি, দেশ লংকা লিমিটেড, পেন্টা হলিডে রিসোর্টসহ পেন্টা গ্রুপ বিডি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ১৯৫৭ সালের ৬ নভেম্বর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাস পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পিতা মরহুম মোতাহার হোসেন সরকারি চাকরি করতেন। মা মরহুমা হাসিনা বিশ্বাস। সহধর্মিনী ফাতেমা সারোয়ার, ইডেন কলেজ থেকে মাস্টার্স করেন। তিনি পেন্টা গ্রুপের পরিচালক। ব্যক্তিগত জীবনে গোলাম সারোয়ার মিলন এক মেয়ে এবং এক ছেলের জনক। তিনি পুরান ঢাকার আরমানিটোলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন।
এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে একবার কারাবরণও করেন তিনি। ১৯৮৪ সালে ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন। গোলাম সারোয়ার মিলন মানিকগঞ্জ সিংগাইর থেকে দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যও ছিলেন। ১/১১ সময় তিনি কিংস পার্টি গঠনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সমালোচিত হন। এখন তিনি রাজনীতি থেকে অনেকটাই দূরে আছেন। বুধবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে তার ব্যক্তিগত জীবন এবং রাজনীতির সমসাময়িক বিষয় নিয়ে বিবার্তার সাথে খোলামেলা আলাপ করেন। সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেছেন বিবার্তার নিজস্ব প্রতিবেদক জাহিদ হোসেন বিপ্লব।
বিবার্তা : এক এগারোর পর থেকেই আপনি রাজনীতি থেকে অনেকটা দূরে আছেন, এর কারণ কী?
গোলাম সারোয়ার মিলন: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বির্নিমাণ ও অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উচুঁ করে দাড়ানো। আমি এখন দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃত্তি বৃদ্ধিতে রপ্তানিমূখী শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জণের প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত।
বিবার্তা : আপনি ১/১১-এর সময় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, ১/১১ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
গোলাম সারোয়ার মিলন : ১/১১ যে কারণে বা উদ্দেশ্যে এসেছিলো দেশের তৎকালীন বিরজমান বৈরী রাজনীতির গুনগত পরির্বতন আনবে, তারা তা পারেনি। দুই নেত্রীকে মাইনাস করার চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত ভূল ছিলো। তারা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের ওপর হাত দিয়েছিল তাও সঠিক ছিলো না। বরং বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার কারণে দেশ-বিদেশে সমালোচিত হতে হয়েছে।
বিবার্তা : ১/১১ কুশীলবদের বিচারের দাবি উঠেছে, আপনিতো তথাকথিক কিংস পার্টিতে জড়িত ছিলেন। আপনি নিজের দায় এড়াবেন কিভাবে?
গোলাম সারোয়ার মিলন : প্রথম কথা, কিংস পার্টি বলতে কোনো পার্টি ছিলো কি না আমার জানা নেই।দ্বিতীয়ত, ড. ফেরদৌস কোরাইশীর নেতৃত্বে আমরা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করলেও আমরা কি সুবিধাভোগী? বা এ দলের কেউ কি কোনো অন্যায় কাজে লিপ্ত ছিলো? এ রাজনৈতিক দল গঠনে যারা জড়িত ছিলো তারা সকলেই ভুক্তভোগী। উপরন্তু, আমরা দুইনেত্রীকে মাইনাস করার ফর্মূলার বিরোধীতা করেছিলাম।
বিবার্তা : ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
গোলাম সারোয়ার মিলন : সাংবিধানিক প্রয়োজনে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রয়োজন ছিলো। তবে আগামী নির্বাচনগুলো সবার অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া উচিত।
বিবার্তা : যেহেতু সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়নি, সেজন্য আগাম নির্বাচন প্রয়োজন আছে কি?
গোলাম সারোয়ার মিলন : এটা সকল দলের সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
বিবার্তা : দেশের বিদ্যমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন যাচ্ছে?
গোলাম সারোয়ার মিলন : দেশ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি স্থিতিশীল। আগের তুলনায় অনেক বেশি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বিদ্যমান। বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে পারলে অর্থাৎ তাদের নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকলে ব্যবসায়ীরা আরো বেশি করে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবে।
দেশে সব সরকারের সময়ই কম-বেশি হত্যা, সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে। তবে শিশু হত্যা ও নির্যাতন আংশকাজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমার মনে হয় আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই তা ঘটছে। এজন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
বিবার্তা : আপনি একাধিকবার সংসদ সদস্য ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন কি?
গোলাম সারোয়ার মিলন : এলাকার জনগণ আগামী সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ করছে। কিন্তু এখনও আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে জনগণ চাইলে আমি সিদ্ধান্ত নেব।
বিবার্তা : সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া যে মন্তব্য করেছেন, সে বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
গোলাম সারোয়ার মিলন : একজন জাতীয় নেতা হিসেবে এ বিতর্কে তিনি (খালেদা জিয়া) না জড়ালে ভাল করতেন। পাশাপাশি পাকিস্তান যখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কুটক্তি করে এবং মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করতে চায় তখন উনার নিরবতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের জনগণের অনুভূতিতে আঘাত হানে।
বিবার্তা : বিএনপি বা আওয়ামী লীগ অথবা এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না?
গোলাম সারোয়ার মিলন : আমি এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। সময়ই বলে দেবে আমি কী করবো, কোথায় যাবো।
বিবার্তা : বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন?
গোলাম সারোয়ার মিলন : রাজনীতি হচ্ছে কৌশলের খেলা। বিএনপি সেই কৌশলে ভূল করেছে। তবে আওয়ামী লীগ যেমন ঐতিহ্যবাহী পুরোনো দল পক্ষান্তরে বিএনপিও এ দেশে বড় একটি রাজনৈতিক দল। দেশবাসীর কাছে এই দুটি দলেরই গ্রহণযোগ্যতা আছে।
বিবার্তা : বিএনপি কি চলমান সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে?
গোলাম সারোয়ার মিলন : কোনো সরকারই শেষ সরকার নয়। বিএনপি যদি তার অতীতের ভূল থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে তাহলেই তাদের পক্ষে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
বিবার্তা : দীর্ঘদিন জাতীয় পার্টির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, জাতীয় পার্টি এবং এরশাদ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
গোলাম সারোয়ার মিলন : এরশাদ সম্পর্কে মানুষ যাই বলুক না কেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, উনি সবসময় নির্বাচিত হয়েছেন। অনেকে তাকে স্বৈরাচার বললেও একথাও সত্য জেলে থেকেও পাঁচ পাঁচটি আসনে এইচ এম এরশাদের জয়লাভ করাও বিশ্বে একটি বিরল ঘটনা।
তবে তিনি যদি রাজনীতিতে স্থির সিদ্ধান্তে অটল বা অটুট থাকতেন তাহলে জনগণ ডানে বায়ে না তাকিয়ে তাকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসাতো। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক থাকতে পারেননি এবং সে আস্থা পুরোপুরি অর্জন করতে পারেননি। তবে এ কথাও ঠিক যে, তিনি কখনও মুক্ত একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেননি বা মুক্ত রাজনীতিবিদ হতে দেয়া হয়নি।
বিবার্তা : অভিযোগ রয়েছে, সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার, মামলা এবং বাক-স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মত কী?
গোলাম সারোয়ার মিলন : দেখুন, আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা এবং মূল্যবোধ ও সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাবের কারণে, পরমত সহিঞ্চুতার অভাবে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। তবে বর্তমানে দেশের বিরাজমান অবস্থায় দুই নেত্রীই পারেন জাতীয় মৌলিক ইস্যুতে ঐকমত্য হয়ে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রূপ দিতে।
বিবার্তা/বিপ্লব/মহসিন