সোয়েব রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। থাকেন নিউজিল্যান্ডে। লিংকন ইউনিভার্সিটিতে ‘ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট’ নিয়ে পিএইচডি করছেন। পিএইচডি গবেষণার কাজে সম্প্রতি এসেছেন দেশে। বাংলাদেশের পর্যটন এলাকা রাঙামাটি ও বান্দরবানে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনযাত্রা ও টেকসই পর্যটন নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের নানা দিক নিয়ে কথা বলেন বিবার্তা২৪.নেটের নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজের সাথে।
আপনার জন্ম, পরিবার নিয়েই শুরু করুন জীবনের গল্প।
জন্ম ফরিদপুরে মধুখালীর নানা বাড়িতে। শৈশব-কৈশোর কেটেছে নিজের বাড়ি ফরিদপুরে। বাবা মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন। মা সুফিয়া বেগম। দুই ভাই এক বোন। বড় ভাই ইসহাক-উর-রহমান ও বোন মোহসেনা মমতা। বাবা-মা দু’জনই সরকারি চাকরি করতেন। বাবা উপজেলা প্রশাসনিক কর্মকর্তা আর মা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। বর্তমানে তারা অবসরে আছেন।
প্রাইমারি স্কুল জীবনের কোন ঘটনাটি বেশি মনে পড়ে?
প্রাইমারি স্কুল জীবনের স্মরণীয় ঘটনা হলো- একই সাথে আমি দুটি স্কুলে পড়ালেখা করেছি। অনির্বান বিদ্যানিকেতন কিন্ডার গার্টেনে আর মেছড়দিয়া পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সকাল ৬-১০টা কিন্ডার গার্টেনে। সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তখনকার সময়ে কিন্ডার গার্টেনে প্রথম আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়। সেখানে প্লে গ্রুপ থেকে শুরু করে ক্লাস টু পর্যন্ত ছিল। আর সাধারণ জ্ঞান, অংকন, জীবন গঠনমূলক ও সৃজনশীল বিভিন্ন বিষয় ছিল। যা সরকারি স্কুলে ছিল না।
দুই স্কুলে পড়াশুনা করতে গিয়ে সমস্যা হতো না?
ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনা বিষয়ে সচেতন ছিলাম। বেশি পড়াশুনা করতে হতো না। ক্লাসের পড়া ক্লাসে বসেই সেরে নিতাম। বাড়িতে এসে বাকি সময়টা নিজের মতো করে খেলাধুলা, ঘোরাঘুরি, সাঁতার কাটা, ঘুড়ি উড়িয়ে মজা করে সময় কাটাতাম। খেলাধুলার মধ্যে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাটমিন্টন, ডাংগুলি, মারবেল, লাটিম বেশি খেলতাম। এভাবেই ছেলেবেলার সময় কেটে গেছে। ক্লাস ফাইভে সমাপনী পরীক্ষায় থানাভিত্তিক রেজাল্টে ২০ জনের মেধাতালিকায় ১৪তম স্থান লাভ করি।
হাইস্কুল জীবনের স্মরণীয় ঘটনা বলুন।
হাইস্কুল জীবনের শুরুতেই একটা মজার ঘটনা ঘটে। ক্লাস ফাইভ থেকেই টিভিতে বিতর্ক প্রতিযোগিতা দেখতে ভালো লাগত। সব সময়ই দেখতাম বিতর্কে ক্যাডেট কলেজের ছাত্ররা জয়ী হতো। তখন থেকেই খাকি ড্রেসের প্রতি একটা ভালোলাগা কাজ করতো। ফাইভ পাস করার পরে ঝিনাইদহ প্রগতি প্রিক্যাডেট স্কুল অ্যান্ড কলেজে আমাকে ভর্তি করানো হয়। ছোটবেলা থেকেই দাদির সাথে ঘুমানোর অভ্যাস। হোস্টেলে ঘুমাতে পারি না। নিয়মকানুন ভালো লাগে না। সিদ্ধান্ত নিলাম চলে যাব বাড়িতে। পাঁচদিনের দিন ছিল শবেবরাত। সারা রাত নামাজ পড়লাম, যেন পরের দিন ভালোভাবে পালাতে পারি। বিকেলে সবাই তখন ক্রিকেট খেলা নিয়ে ব্যস্ত। চারটি প্যান্ট, চারটা জামা এক সাথে পরে এগুলোর উপরে ট্রাকসুট পরে নিলাম। দেখতে অনেক মোটা লাগছিল। আমি হোস্টেল থেকে বেরিয়ে খেলার মাঠ দিয়ে সোজা বাড়িতে চলে এলাম।
তারপর কী করলেন?
বাড়িতে এসে মধুখালী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে সিক্সে ভর্তি হই। ওইদিনগুলো ছিল রুটিনবদ্ধ জীবনের মতো। তবে অনেক আনন্দ করেছি। ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষার সময় একটা মজার ঘটনা ঘটে। আমার হাতের লেখা বরাবরই ছিল অনেক খারাপ। ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষা হয় ফরিদপুর গার্লস স্কুলে। পরীক্ষার হলে খাতা সিগনেচার করতে এসে আমার খাতা দেখে একজন টিচার বলেন, ‘তুমি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে আসছো কেন?’ শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। পরীক্ষা শেষে বাড়িতে চলে গেলাম। ভাবলাম পাস করব না। কিছুদিন পরে আমি মার্কেটে গেছি। তখন আমার এক কাজিন এসে বলে, ‘অ্যাই তুই এখানে কী করিস। তুই বৃত্তি পাইছিস।’ আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। পরে স্কুলে গিয়ে দেখি আমাদের মধুখালী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে দু’জন মেয়ে ও একজন ছেলে বৃত্তি পেয়েছে। ওই ছেলেই আমি ছিলাম।
এসএসসিতে কোন বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন?
হাইস্কুলে আমার রোল নম্বরের একটা সিরিয়াল ছিল। ক্লাস সিক্সে রোল নম্বর ছিল ফাইভ, সেভেনে ফোর, এইটে থ্রি, নাইনে টু, টেনে ওয়ান। যাদের রোল ১-৩ এর মধ্যে থাকতো তারা সাইন্স নিতো। কিন্তু সাইন্স বিষয়টি আমার ভালো লাগতো না। তখন আমার বড় ভাই আমাকে ব্যবসায় শিক্ষা নিতে বললে আমি ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে পড়ালেখা শুরু করি। এসএসসিতে মধুখালী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের সবার মধ্যে দ্বিতীয় হই। স্টার মার্কস পেয়ে পাস করি।
কোন কলেজে পড়েছেন? কলেজ জীবন আপনাকে কী দিয়েছে?
ঢাকা কলেজ এমন একটা জায়গা যেটা আমার জীবনটাকে নতুনভাবে চিনিয়েছে। জীবনটাকে ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। আমি ছিলাম অনেকটা ইন্ট্রোভার্টেড স্বভাবের। কলেজে পড়ে কীভাবে মানুষের সাথে মিশতে হয়। প্রতিকূল পরিবেশে সব ঠিক রেখে কীভাবে সবার সাথে চলতে হয় এগুলো শিখিয়েছে আমাকে কলেজ জীবন।
বিবিএ ও এমবিএ করেছেন কোথা থেকে?
ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসিতে স্টার মার্কস পেয়ে পাস করি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যুরিজম অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে বিবিএ ও এমবিএ করি। ছোটবেলা থেকেই ভ্রমণ করতে পছন্দ করতাম। তাই পর্যটন একটা ভালোলাগার বিষয় ছিল। সে ভালোলাগা থেকেই পর্যটন নিয়ে পড়ালেখা করা।
এমবিএ করার পর প্রথম শিক্ষকতা শুরু করেন কোথায়?
এমবিএ শেষ করেই গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে লেকচারার অব ম্যানেজমেন্ট পদে চাকরি শুরু করি। তরুণ শিক্ষক হিসেবে অনেক প্রস্তুতি ও আন্তরিকতা নিয়ে ক্লাস নিতে শুরু করি। অল্পদিনের মধ্যেই স্টুডেন্টদের সাথে বন্ধুত্ব হয়। ক্লাস নিতে ভালোলাগা শুরু হয়। ৫ ঘণ্টার জায়গায় ১২ ঘণ্টা কাজ করতেও ক্লান্তি লাগতো না। শিক্ষকতা পেশার প্রতি আন্তরিকতা ও সেবামূলক মনোভাব দেখে কলেজের ম্যানেজমেন্ট আমাকে অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব দেয়।
এরপরে কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব দেয়। ধীরে ধীরে কাজের ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি ভালোবাসা বাড়তে থাকে। এক বছর ১০ মাস কাজ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সার্কুলার দেখে আবেদন করি। চাকরিটা হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যুরিজম অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগে চাকরি শুরু করি ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালের শেষের দিকে নিউজিল্যান্ডের ‘কমনওয়েলথ স্কলারশিপ’ পেয়ে ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পিইচডি করার সুযোগ পাই। বর্তমানে নিউজিল্যান্ডের লিংকন ইউনিভার্সিটিতে ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পিএইচডি করছি। সম্প্রতি দেশে এসেছি আমার পিএইচডি বিষয়ে গবেষণার জন্য।
কী বিষয়ে গবেষণা করছেন?
পিএইচডি ঘবেষণার বিষয়-‘হাউ কো-ম্যানেজমেন্ট অব ট্যুরিজম ডেভলভমেন্ট সাপোর্টস দ্য অ্যানহ্যান্সমেন্ট অব কমিউনিটি অয়েলবিং? দ্য কেইস অব হিল ট্রেকস বাংলাদেশ’(How co-management of tourism development supports the enhancement of community wellbeing? The case of hill tracts Bangladesh.)। আমি এ রিসার্চে তুলে ধরতে চাই সহ-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কীভাবে টেকসই পর্যটন উন্নয়ন করা যায়। আর কমিউনিটির কল্যাণে তার অবদান রাখা যায়। পাশাপাশি কমিউনিটির কল্যাণ নিশ্চিত হলে টেকসিই পর্যটনে কীভাবে ভূমিকা রাখা সম্ভব।
এখন একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। নিউজিল্যান্ডের জীবনযাত্রা নিয়ে কিছু বলুন।
কৃষ্টি-সংস্কৃতি ভেদে খাওয়া-দাওয়া, জীবনযাত্রা ভিন্ন হয়। সেখানেও একই অবস্থা। প্রথমে সেখানকার হালকা খাবার খেতে চেষ্টা করেছি। ভালো লাগে না। পরে নিজে ভাত, তরকারি রান্না করে খেতে শুরু করি। জীবন চলে রুটিনের মাধ্যমে। পড়াশুনা, খাওয়া আর কাজ। পড়াশুনার পাশাপাশি সেখানে টিউটর হিসেবে পার্টটাইম একটা জব করি। নিউজিল্যান্ডের মানুষ আন্তরিক ও অতিথিপরায়ন। পোশাক-আশাক পাশ্চাত্যের ধাঁচের। কথাবার্তা আচার-ব্যবহার মার্জিত। সবাই একে অন্যকে সাহায্য করতে পছন্দ করে।
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?
বংলাদেশের পর্যটনশিল্পে অনেক সম্ভাবনা আছে। আমার চোখ দিয়ে দেখি, চিন্তাভাবনা দৃষ্টি দিয়ে দেখি। এখানে কিছু পরিবর্তনের দরকার। সবার সচেতনতা বাড়াতে হবে। দেশের জনগণকে নিয়ে যদি কিছু উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ নেয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট একটা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। জাতি ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সবাই এক সাথে কাজ করতে হবে।
পর্যটনশিল্প নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
আমার ধ্যানজ্ঞান, চাওয়াপাওয়া, স্বপ্ন সবই এখন পর্যটনশিল্পকে ঘিরে। দেশের টেকসই পর্যটনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। এ শিল্পকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, কীভাবে বিকশিত করে মানুষের কাছে তা পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়, তা নিয়ে ভাবছি। গবেষণা করছি। দেশের সব কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে পর্যটন শিল্পকে উন্নত করার কথা ভাবছি। বর্তমান সরকার এ শিল্পকে নিয়ে যে পরিকল্পনা করছে সে পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নে আমার মেধা, গবেষণা ও আন্তরিক চেষ্টা দিয়ে সহযোগিতা করবো। আগামী ১০ বছরের পরিকল্পনা হলো যে কোনো মূল্যেই হোক দেশের টেকসই পর্যটনে কাজ করে একটা ভালো অবস্থানে নিতে চেষ্টা করা।
শিক্ষক হিসেবে আপনার জীবনে কোন ঘটনাটি বেশি মনে পড়ে?
ঢাবিতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার পরে ২০১৪ সালে আমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট-এর প্রফেসর মজিব উদ্দিন আহমেদ ফান্সের ইউনিভার্সিটি অব টোলোজের (Toulous) নিমন্ত্রণে এক সপ্তাহের একটা লেকচার সিরিজে অংশগ্রহণ করি। ওই দিনগুলোর কথা আমার অনেক মনে পড়ে।
অবসরে কী করতে পছন্দ করেন?
আমার পছন্দের বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো ট্রেকিং করা। ইতোমধ্যেই তাজিংডংয়ে ট্রেক করেছি। কেওকারাডাংয়ে তিনবার গিয়েছি। নিউজিল্যান্ডেও ট্রেকিং করি।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/জিয়া/কাফী