সমাজ থেকে অপরাধ একদিনে তাড়ানো যায় না। বিভিন্ন পন্থায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। তবে সাম্প্রতিক অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা এটাই মনে করিয়ে দিতে পারে, বর্তমানে সারাদেশে অপরাধ ক্রমাগত বাড়ছে।
কেন এসব অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে, এর পিছনের কারণ কি, এ থেকে উত্তরণের উপায় কি প্রভৃতি বিষয়ে জানতে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমানের সাথে। তিনি এ বিভাগে ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত চেয়ারম্যান পদে আছেন। তিনি মনে করেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতিই আমাদের দেশে সেলিম ওসমানদের পয়দা করছে।
উল্লেখ্য, ক্রিমিনোলজি বিষয়টি আমাদের দেশে নতুন। ঢাবিতে ২০১৪ সাল থেকে এ বিভাগ অফিসিয়ালভাবে চালু হয়। বিবার্তার পাঠকের উদ্দেশ্যে তার সাথে আলাপ-আলোচনার কিছু অংশ নিচে দেয়া হলো-
বিবার্তা: ক্রিমিনোলজি বিষয়টি আমাদের দেশে নতুন। কি আছে এতে, একটু ব্যাখা করবেন কি?
ড. জিয়া রহমান: এটা আমাদের দেশে নতুন বিষয়। কি কারণে মানুষ অপরাধ করে এটিই কিন্ত ক্রিমিনোলজির মূল বিষয়। তিনটি ভাগে ভাগ করে ক্রিমিনোলজি পড়ানো হয়। ভায়োলেন্ট ক্রাইম, প্রপারটি ক্রাইম ও ভিকটিমলেস ক্রাইম। এছাড়া, এর সাথে যুক্ত আছে ওয়েসটার্ন বিশ্বের সাথে আমাদের এখানকার অপরাধের ধরনের পার্থক্য কি। পুলিশিং, কোর্ট, প্রিজন এসব কিছুর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে। পুলিশের রোল, তার এক্টিভিটিজ, তাদের ডাইনামিজম, তাদের ওয়ার্ক যেমন আছে, একই সাথে কোর্ট কিভাবে পরিচালিত হয়, কোর্টের বিভিন্ন সমস্যা; আবার কারাগার, ওয়েস্টে যেটা সংশোধনাগার নামে পরিচিত সেটিও নিয়ে আলোচনা আছে। প্রিভেনশন কিভাবে করানো হয় এটাও আমরা পড়াই। এছাড়াও ক্রিমিনোলজির সাথে জড়িত ও এর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা নিয়েও আলোচনা আছে।
বিবার্তা: মানুষ কেন অপরাধ করে, কেন স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে অপরাধী হয়? কে দায়ী এর জন্য- ওই ব্যক্তি নিজে, তার পরিবার, সমাজ না রাষ্ট্র?
ড. জিয়া রহমান: ‘সিজার লমব্রসো’কে ফাদার অব মর্ডান ক্রিমিনোলজি বলা হয়। তার মতে, ফিজিক্যাল স্ট্রাকচারের কারণে মানুষ অপরাধ কর্মে জড়িত হয়। তিনি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, মানুষ ফিজিক্যাল স্ট্রাকচারের পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনের কারণেও ক্রাইম করে। এছাড়া মনস্তাত্তিক, পরিবারের ধরন, সমাজ ইত্যাদি কারণেও মানুষ অপরাধ করে। এছাড়া বলা হয় একজন মানুষের তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে যেসব রিসোর্স দরকার সেগুলো যদি না পায় তখন সে নেগেটিভ জায়গা থেকে লক্ষ্যটাকে অ্যাচিভ করার চেষ্টা করে এবং এভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তবে সোস্যাল ফ্যাক্টর গুলোকে বর্তমান সময়ে মূলত আমলে রাখা হচ্ছে অপরাধের কারণ হিসেবে।
বিবার্তা: পশ্চিমা বিশ্বে কারাগারগুলোকে ‘সংশোধনাগার’ বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। কিন্ত একজন জাত অপরাধী কি কখনো সংশোধিত হয়?
ড. জিয়া রহমান: ওয়েল। মানুষের মর্যাংলের যে জায়গাটা থাকে, সেটি যদি সংশোধনের মাধ্যমে ডেভলপমেন্ট করা যায় তাহলে মানুষ তার বিবেককে পজিটিভ দিকে ধাবিত করে নিজেকে পরিবর্তন করতে পারবে। কারাগারে যদি তার অনুশোচনা, তার মটিভিশন ও প্লেজার নিশ্চিত করা যায় তাহলে তার মধ্যে পরিবর্তন নিশ্চিত। একই সাথে কারাগার যদি কোন অপরাধীকে ভাল-চিন্তা চেতনার জায়গা তৈরি করে দিতে পারে তাহলেও নিশ্চিত তার মধ্যে পরিবর্তন আসবে। সমাজে বিভিন্ন ধরনের (ছোট, বড়) অপরাধের ধরন যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে আমি বলবো, এ দায় সমাজের, রাষ্ট্রের এবং এখান থেকে যদি তার জীবনবোধ, জীবনের প্রতি ভালবাসা, দেশের ও সমাজের প্রতি মমত্ববোধ তৈরি করা যায়, তাহলে অপরাধী নিজেকে পরিবর্তনের সুযোগটা পায়। এক্ষেত্রে কারাগারের অবশ্যই ভূমিকা আছে।
বিবার্তা: অপরাধী কিভাবে তৈরি হয়- জন্মসূত্রে নাকি পরিবেশের প্রভাবে? এ বিষয়ে অপরাধ বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ কি?
ড. জিয়া রহমান: আগে জন্মগত ক্রিমিনালের কারণে অপরাধী তৈরি হতো। তবে এটি বর্তমানে অবসোলিট হয়ে গেছে। বর্তমান এটির মূল কারণ হিসেবে সমাজকে দায়ী করা হয়। আর এই সমাজকে প্রভাবিত করে পরিবার। পরিবার পজিটিভ হলে অপরাধ কম, নেগেটিভ হলে বেশি হয়। আর বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের পরিবারগুলো প্রভাবিত হচ্ছে ভারতীয় টিভি সিরিয়াল দেখার কারণে। আর একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সেটি দারিদ্র্যঅ দারিদ্র্যের কারণেও মানুষ অপরাধে জড়ায়।
বিবার্তা: অপরাধ নির্মূলে শাস্তি না পুনর্বাসন কোনটি বেশি কার্যকর বলে আপনি মনে করেন?
ড. জিয়া রহমান: বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে মানুষকে শাস্তির মাধ্যমে শাসন করার ব্যবস্থা যদি না থাকতো তাহলে মানুষ আরো বেশি অপরাধকর্মে লিপ্ত হতো। তাই সে জায়গা থেকে অবশ্যই মনে করি শাস্তির বিধান কার উচিত। দীর্ঘমেয়াদি হেলথি সোস্যাইটি গড়তে শাস্তির পাশাপাশি প্রিভেনশনের ব্যবস্থা করা উচিত। কাজেই আমি মনে করি প্রিভেনশনের কোনো বিকল্প নেই।
বিবার্তা: আমাদের চারপাশে প্রতিদিন অসংখ্য অপরাধ ঘটে চলেছে। ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে এগুলোকে আপনি কিভাবে শ্রেণীকরণ করছেন?
ড. জিয়া রহমান: ওয়েল। বর্তমান সময়ে যে সকল অপরাধগুলো হচ্ছে সেগুলোকে আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে থাকি। এক. অর্থনৈতিক অর্থাৎ পেটি থেপট। পেটের দায়ে যে অপরাধগুলো মানুষ করে। এগুলো সরাসরি আমি দারিদ্র্যের সাথে সম্পৃক্ত করতে চাই। দুই. ভায়োলেন্ট ক্রাইম। সমাজের মানুষের চাহিদা পূরণে আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হওয়ায় এই ভায়োলেন্ট ক্রাইম হয়ে থাকে। তিন. সামাজিক অসমতা। সমাজে বসবাসকারী মানুষের মধ্যেও ভাগ হয়ে গেছে। সমাজে প্রভাবশালীদের কোনো অপরাধ অপরাধ বলেই গণ্য হয় না। কিন্ত অন্যদিক, ক্ষমতাহীনদের সামান্য অপরাধ বড় করে দেখা হয়। আর এই সামাজিক অসমতার কারণেই বেশি অপরাধ সংগঠিত হয়। এই তিন ধরনের অপরাধকে আমি মোটা দাগে চিহ্নিত করছি। এছাড়াও সামাজিক পরিবর্তন, মাদকাসক্তি, বর্তমান সময়ে ছেলে-মেয়েদের মধ্যকার অসামাজিক সম্পর্ক, জঙ্গিবাদ, ক্ষমতাহীন ও সামাজিক ন্যায়বিচার না হওয়া ইত্যাদি শ্রেণীতেও ভাগ করছি।
বিবার্তা: অনেকেরই এখন এই মত যে, বিচারহীনতার সংস্কৃতিই আমাদের সমাজে অপরাধ ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার কারণ। আপনিও কি তাই মনে করেন? কেন?
ড. জিয়া রহমান: অবশ্যই। আমি মনে করি এটাই একমাত্র কারণ। খুবই স্বাভাবিক। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই আমাদের সমাজে সেলিম ওসমানের মতো আরো সেলিম ওসমান তৈরি করছে। রাজনীতি, সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি একই সাথে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্নত না হওয়ার কারণে এই সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
বিবার্তা: অপরাধ দমনে ক্রিমিনোলজি বিভাগের আসলেই কি কোনো ভূমিকা আছে বা থাকা উচিত? আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কি বলে?
ড. জিয়া রহমান: অবশ্যই। আমাদের অনেক গবেষণার মাধ্যমেই আমরা অপরাধ দমনে ভূমিকা পালন করে থাকি। এ ক্ষেত্রে ক্রিমিনোলজি বড় ভূমিকা পালন করে। এ ভূমিকা পালনে ক্রিমিনোলজির রিসার্চের কোনো বিকল্প নেই।
বিবার্তা: ধন্যবাদ আপনাকে।
ড. জিয়া রহমান: বিবার্তাকেও ধন্যবাদ।
বিবার্তা/রেজা/জিয়া