সফটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের প্রধান সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক পদেও রয়েছেন শামীম আহসান। এছাড়া ফেনক্স ভেঞ্চার ক্যাপিটালের জেনারেল পার্টনার এবং প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সেরও সদস্য তিনি।
দেশের সুপরিচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বাগডুমডটকমের চেয়ারম্যান এবং সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান ই-জেনারেশন লিমিটেডের চেয়্যারম্যান হিসেবেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন শামীম। এই খাতে ‘সেরা তরুণ উদ্যোক্তা’ পুরস্কারপ্রাপ্ত এ সংগঠক ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সরকার, বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক পরিসরে নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করে চলেছেন।
গত বুধবার রাজধানীর গুলশানে বাগডুমডটকমের প্রধান কার্যালয়ে আগামী ২৫ জুন অনুষ্ঠেয় বেসিসের ২০১৬-১৯ সেশনের নির্বাচনের হালচাল নিয়ে তিনি মুখোমুখি হন বিবার্তা২৪ডটনেটের সাথে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বিবার্তা২৪.নেটের নিজস্ব প্রতিবেদক উজ্জ্বল এ গমেজ।
বিবার্তা: এবারের নির্বাচনকে কিভাবে দেখছেন?
শামীম আহসান: দেশের তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে বেসিস যে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে এবং সরকারের সাথে যৌথভাবে পলিসি তৈরি, পরিবর্তন বা নেগোসিয়েশন করছে, তা দেখে অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন। গত কয়েক বছরে বেসিস খুবই ভালো কাজ করেছে বলেই এবারের নির্বাচন বেশ সাড়া ফেলেছে। রেকর্ড পরিমাণ নমিনেশন সাবমিট হয়েছে। মিডিয়াও বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে এবারের নির্বাচনকে। আশা করি, এই নির্বাচনে বেসিসের চলমান অগ্রগতির ধারাবাহিকতা, সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতোই নেতৃত্ব আসবে।
বিবার্তা: আপনি কী মনে করেন, বেসিস আপনার শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে?
শামীম আহসান: বেসিসের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে দীর্ঘ পথচলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সবার সহযোগিতা পেয়েছি। আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে বেসিসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। গত চার বছরে অনেক নতুন নেতৃত্ব এসেছে। সফলতা যা এসেছে তা যৌথভাবে কাজ করার মাধ্যমেই এসেছে। তারা প্রত্যেকেই একাধিক প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছেন। তাদের প্রত্যেকেরই নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্যতা রয়েছে। এবারের নির্বাচনে আমি অংশগ্রহণ না করলেও দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে বেসিসসহ আপনাদের পাশে সবসময় থাকার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তাই আমার শূন্যস্থান তৈরি হবে বলে আমি মনে করি না। আর নেতৃত্ব সবসময় একজনের থাকে না। আমি আশা করি, নতুন নেতৃত্ব বেসিস তথা দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে।
বিবার্তা: বেসিস সভাপতি হিসেবে নিজের মেয়াদকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করতে চান?
শামীম আহসান: আমাদের মেয়াদে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বেসিসের সদস্য কোম্পানিগুলোর জন্য দেশে ও বিদেশে বাজার সৃষ্টি করা এবং তাদের ব্যবসায় সম্প্রসারণে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে একাধিকবার ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড, বাংলাদশ ইন্টারনেট উইক, বেসিস সফটএক্সপো, বাংলাদেশ ইনফরমেশন সিকিউরিটি এক্সিবিশন অ্যান্ড কনফারেন্স, বিজনেস সফটওয়্যার শোকেস, বাংলাদেশ আইটি মার্কেটিং ফোরাম, ডিজিটাল ইনভেস্টমেন্ট সামিট, ই-কমার্স নিয়ে দেশের প্রথম প্রদর্শনী ‘ই-কমার্স উইক’, ইউ-এস বাংলাদেশ টেক ইনভেস্টমেন্ট সামিট আয়োজনসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন আয়োজনে বেসিস সদস্যদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। এগুলোতে বেসিসের সদস্য কোম্পানিগুলো যাতে ব্যবসায়িক উন্নয়নে পারস্পরিক পরিচিতি ও আলোচনায় মিলিত হতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড হলো এমন একটি প্লাটফর্ম, যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছিলেন এবং সকল মন্ত্রী, সচিব, চিফ ইনোভেশন অফিসার (সিআইও)’সহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাদের নিজস্ব মন্ত্রণালয়ের স্টলে উপস্থিত হয়েছিলেন। এর ফলে বেসিসের সদস্য কোম্পানিগুলো সরাসরি তাদের সাথে পরিচিত হতে পেরেছেন এবং তাদের সামনে নিজেদের সেবাগুলো তুলে ধরতে পেরেছেন। যার ফলে সরকারি কাজে অনেকেরই অংশগ্রহণ বেড়েছে। একইভাবে এনটিএফ-৩ প্রকল্প ও ইপিবির সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছু মেলা, সম্মেলন, সেমিনার, বিটুবিতে সদস্য কোম্পানিগুলোকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের সাথে বৈঠক করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলো স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পেরেছেন। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প তৈরিতে সহায়তা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বেসিসের সদস্য কোম্পানিগুলো কাজ করতে পারছে।
বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক ও কারওয়ান বাজারে জনতা টেকনোলজি পার্ক যে আলোর মুখ দেখেছে তার পেছনেও সরকারের পাশে থেকেছি আমরা। আমরা ২৩ হাজার দক্ষ জনশক্তি তৈরি করছি। তরুণদের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর পেশায় আগ্রহ সৃষ্টির মাধ্যমে বর্তমানে এই খাতে প্রায় সাত লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের মেয়াদের শুরুতে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে রফতানির পরিমাণ ছিলো মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলার। এখন সেটি ৪০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এক অনন্য উচ্চতায় আনতে সমর্থ হয়েছি আমরা, যার ফলে বাংলাদেশে এখন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশ্বের শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বীকৃতি পাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির পরবর্তী গন্তব্যস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে বাংলাদেশ।
আমাদের এই অগ্রযাত্রা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বিসিসি, এটুআই, বিওআই, এনবিআর, ইপিবি, আইবিপিসি, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, ইউজিসিসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ব্যাংক, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টার, নেদারল্যান্ড ট্রাস্ট ফান্ড, বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে বিভিন্ন দূতাবাস, জাইকা, এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, বিটিআরসি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি, আইএসপিএবি, বাক্য, সিটিও ফোরাম, অ্যামটব, ই-ক্যাব, বিডব্লিউআইটি, বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, ব্যবসায়ীদের অকৃত্রিম সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব ছিলো না। তাই তাদেরকে অনেক ধন্যবাদ জানাই।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে আমাদের গণমাধ্যম। বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরামসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন, পত্রিকা, নিউজপোর্টাল, ম্যাগাজিন, রেডিও তাদের প্রচারের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে আমাদের অর্জন, সক্ষমতা ও সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছেন।
বিবার্তা: বাংলাদেশের আইটি খাতের ভবিষ্যত কেমন দেখছেন?
শামীম আহসান: আমি আগেই বলেছি, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। ফেনক্স ভেঞ্চার ক্যাপিটালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। আগামীতে আরও কিছু ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি আসবে। সরকার ২০২১ সাল নাগাদ এই খাত থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলোর আন্তর্জাতিক মানের সক্ষমতা রয়েছে। আইসিটি ডিভিশন ও বেসিস মিলে ১০০০ উদ্ভাবনী প্রকল্প তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবেই ভালো উদ্যোগ তৈরি হচ্ছে। তাই মনে করি এসব সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে আমাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ভবিষৎ আরও ভালো হবে।
বিবার্তা: ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে আপনার ভাবনা কি?
শামীম আহসান: ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সরকার অনেক দূর এগিয়েছে। বেশ কিছু সরকারি সেবায় ডিজিটালের ছোঁয়া, ইউনিয়ন পর্যন্ত উচ্চগতির ফাইবার অপটিক ক্যাবল পৌঁছে যাচ্ছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে জনগণ ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তির সেবা নিচ্ছে। তবে পুরোপুরিভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে হলে আরও বেশি কাজ করা প্রয়োজন। স্থানীয় কোম্পানিগুলো যাতে সরকারি কাজ পায় বা অগ্রাধিকার থাকে, বাজেটের এডিপিতে (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) ন্যূন্তম ১০ শতাংশ যাতে আইটিতে বরাদ্দ দেয়া ও খরচ করা হয়, বিদেশে বাংলাদেশের কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ে আরও গুরুত্ব দেয়া হয় এমন প্রস্তাব আমরা আগে থেকেই করে আসছি। বিষয়গুলোতে নজর দিলে ও দেশীয় কোম্পানির জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারলে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন হবে।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/মৌসুমী