আজ পর্যন্ত যত লেখাই লিখেছি কোনটাই কাল্পনিক বা বানোয়াট নয়। সবটাই আমার দেখা বা জানা শোনা সত্য ঘটনা আমি লিখেছি। আজ এখন যা লিখবো তাও সম্পূর্ণ সত্য তবে পার্থক্য এটাই যে এখানে ঘটনাটা আমার সাথেই। তাই আমি অভিজ্ঞতার থেকে ছোট একটু ধারনা দিবো যে টাকাই জীবনে সব নয়। এটাও বড় বেশী সত্যি।
লেখাটি লিখতে গেলে আমার সম্পর্কে কিছুটা লিখতেই হচ্ছে, তা না হলে বোঝানো একটু কঠিন হবে। আমার জন্ম ঢাকায়, বড় হয়েছি ঢাকায় আর এখনও আমি ঢাকাতেই আছি বা থাকি। আমার বাড়ি ঢাকার উত্তরায়। হয়তো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজের সূত্রে ঢাকার আশে পাশের থানায় বা জেলায় জীবনের অনেকটা সময় থাকতেও হয়েছে, এই আর কি।
যে ঘটনাটি লিখবো, তা আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। আমি আমার বাড়ির পাশে সন্ধ্যার সময় জরুরি একটা দরকারে গেলাম। ঢাকা উত্তরার দোকানে কত মানুষ আসছে যাচ্ছে, কে কাকে দেখে বা চেনে। সবাইতো প্রয়োজনে আসে বা চলে যায়। যা হয় আর কি, খুব পরিচিত না হলে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। যথারীতি কাজ শেষ করে আমি বাড়ির দিকে যাচ্ছি। ঠিক আমার পাশেই আরেকটি লোক হাটছে। প্রথমে অনুমান করলাম, পরে নিশ্চিত হলাম যে উনি আমার পিছেই হাটছে। যখন আমি আমার বাড়ির খুব কাছে চলে আসলাম। তখন লোকটি আমাকে ডেকে বলল- শোনেন একটু কথা বলবো। আমি বললাম- আপনি কি আমাকে বলছেন? উনি বলল- জি আপনাকেই বলছি।
আমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই, একটু কথা বলবেন কি? আমি বললাম- আপনি কে, আপনাকেতো আমি চিনিনা, কেনই বা আপনার সাথে কথা বলবো? উনি বলল- আমার নাম জালাল, আমার বাড়িও এখানেই। আমি আপনার প্রতিবেশী, ভয়ের কিছু নাই, আমি খারাপ কেউ নই, একটু কথা বলেই দেখুন। তখন বললাম- আপনার বাড়ি ঠিক কোনটা? উনি আমাকে বর্ণনা দিয়ে বোঝালো। তাতে আমি না গেলেও উনি কোন বাড়ির বা কোনটা উনার বাড়ি তা আমি অনুমানে বুঝতে পারলাম। তখন জালাল ভাই আমাকে বলল- যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলবো? আমি বললাম- বলেন। উনি বলল- আমি আর আপনিতো ঢাকার মানুষ, বাড়িও একই এলাকায়।
আমরাতো প্রতিবেশী, তারপর আপনিতো ডাক্তার মানুষ। আপনার কাছেতো আমাদের দরকার হতেই পারে। আমরা কথা বলতেই পারি বা আসা-যাওয়া করতেই পারি তাইনা। তখন আমি বললাম- এখন কি বলবেন সেটা বলেন? উনি বলল- আপনার ফোন নাম্বারটা একটু দিবেন। কখনো কোন সমস্যা বা অসুখ-বিসুখ হলে কথা বলবো। আমি দিতে অস্বীকার করলাম। উনি তখন খুব অনুরোধ করল আর বলল- দেননা আপনার কোন ক্ষতি হবে না। বিশ্বাস করে একবার দিয়েই দেখেন, আমি আপনাকে বিরক্ত করবো না। উনার অনুরোধ আমি ফেলতে পারলাম না। আমি আমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে বাসায় চলে গেলাম। তারপর আমি কয়েকদিন পর উনার সম্পর্কে খোঁজখবর নিলাম। তাতে জানলাম উনি আগে বিদেশ ছিল, বাংলাদেশে আসছে বেশ কয়েক বছর আগে। একাধিক ব্যবসা, অবস্থা বেশ ভালো। যাকে বিত্তবান বলা যায়, বিশাল বড় বাড়ির মালিক। ঢাকা উত্তরার মত জায়গায় গাড়িও আছে এবং এলাকায় বেশ প্রভাবও আছে। সবাই মানে বা ভালোই জানে।
তার বেশ কিছুদিন পর উনি আমাকে ফোন দিল। আমি প্রথমে চিনতেই পারিনি। আমি জানতে চাইলে উনি উনার পরিচয় দিয়ে কথা বললে আমি বুঝতে পারলাম। এভাবেই উনি মাঝে মধ্যেই আমাকে ফোন করে। আমি যখনি সময় পাই অথবা শত ব্যস্ততার মধ্যে হলেও কিছু সময় উনার সাথে কথা বলতাম। তখন হঠাৎ আমার সন্দেহ হলো। একদিন উনি ফোন দেবার পর জিজ্ঞেস করলাম- আপনিতো কোনো অসুখ-বিসুখ বা কোনো সমস্যা নিয়ে কখনোই কিছু বলেন না, শুধু এমনিতে দু’এক মিনিট কথা বলেন আর এভাবেই করছেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না? আসলে আপনি আমার কাছে কেন ফোন দেন, কি চান, কি বা আসলে বলবেন? উনি এড়িয়ে গেলেন। এভাবে প্রায় ফোন দিতো, কথা হতো। একদিন আমি উনাকে জোড় করলাম, বললাম- আজ আপনাকে সত্যি বলতে হবে, কেন জানি আপনাকে আমার সন্দেহ হয়। উনি বলল- আমাকে সন্দেহের কিছু নেই, আমি খারাপ নই। আমি আগে বিদেশ ছিলাম, অনেক বছর যাবৎ বাংলাদেশে এসেছি।
বেশ অনেকদিন হলো ব্যবসা করছি। আমার অবস্থা বেশ ভালো, এখানকার চেয়ারম্যান, এমপি সব আমার আত্মীয়-স্বজন। আমাকে সবাই মানে এবং ভালোই জানে। শুনে আমি বুঝলাম, আমি যা জেনেছি উনিও তাই বলল। অর্থাৎ ঠিক আছে সব বলাই। তারপর আরেকদিন ফোন দেওয়ার পর আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম- আপনার পরিবার সম্পর্কে কিছু বলেন? তখন উনি বলল- আমি বিবাহিত, আমার বউ আছে, আমার তিনটি কন্যা সন্তান আছে। বড় মেয়েটা কলেজে পড়ে, মেঝ মেয়েটা স্কুলে পড়ে, ছোট মেয়েটা কোলে ছোট। আমার বয়স পয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে হবে, এই বলল। তারপর আরেকদিন ফোন করার পর বললাম- আপনারতো সব ঠিক আছে, ভালোই আছেন। কিন্তু আমাকে কেন ফোন দেন বা কি বলতে চান। তাতো আমি আজও বুঝতে পারছি না, একটু বলবেন কি? তখন উনি বলল- সেদিন যখন আপনি ঐ দোকানে গেলেন তখন আমি ঐ দোকানেই ছিলাম এবং আপনার কণ্ঠস্বর, আপনার কথা বলা সবটাই সুন্দর।
আমার খুব বালো লাগলো এবং আপনার সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছিল। তাই আপনার পিছে পিছে এসে এতটা অনুরোধ করে আপনার নাম্বারটা নিলাম, আর কিছু না। আমি বললাম- কেন আপনি আমার সাথে এতো কথা বলতে চাইবেন কেন? উনি বলল- ঐ যে বললাম- আপনার কথা খুব ভালো লাগে তাই। আপনি যা বলবেন আমি আপনার জন্য তাই করবো, সব দিবো, আপনাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। আমি সব করবো, আপনি শুধু আমার সাথে একটু কথা বলেন। উনি তাই করতো, প্রায় সময় উনি বাইক নিয়ে এসে আমার বাড়ির সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো, বার বার ফোন দিতো। আমি ব্যস্ততার কারণে সব সময় কথা বলতে পারতাম না। এভাবে প্রায় বছর খানেক কেটে গেল। একসময় আমি বিরক্ত হয়ে বললাম- আপনি এমন করতে পারেন না, আপনি আপনার পরিবারে সময় দিন ভালো লাগবে! আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলুন, দেখবেন ভালো লাগবে! তখন জালাল ভাই বলল- স্ত্রীর সাথে যদি কথাই বলতে পারতাম, তবে কি আপনাকে এতো বিরক্ত করতাম?
আমি বললাম- কি হয়েছে বলুন? দেখি আমি কিছু করতে পারি কি না। প্রয়োজনে আমি আপনার স্ত্রীর সাথে কথা বলবো। উনি তখন খুব হতাশ স্বরে বলল- আমারতো সেই কপাল নেই। আপনি আর কার সাথে কথা বলবেন? আমি বললাম- কেন কি হয়েছে? উনি বলল- আমার স্ত্রী বোবা, সে কথা বলতে পারে না। আমি শুনে অবাক হলাম, বললাম- একি বলেন? কবে থেকে, কি করে হলো? উনি তখন বলল- সে জন্ম থেকেই বোবা। আমি বললাম তবে জেনে শুনে বোবা মহিলাকে বিয়ে করেছে কেন? কি হয়েছিল বলুনতো? তখন উনি বলল- আজ থেকে বিশ বছর আগের ঘটনা। আমার অবস্থা তখন এমন ভালো ছিলনা আমি গরীব ঘরের ছেলে ছিলাম ধনী হবার আশায় বিদেশ যেতে চাইলাম।
কিন্তু বিদেশ যেতে টাকা লাগে যা আমার পরিবারে ছিল না। আমার শশুর আমাকে বলল- আমি তোমাকে বিদেশ যাবার টাকা দিবো। বিনিময়ে তুমি আমার বোবা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে এবং কোনদিন ধনী হলে ওকে ফেলে দিয়ে বিয়ে করতে পারবে না। ওকে কষ্ট দিতে পারবে না এবং এগুলো লিখিত হবে। তখন আমি রাজি হলাম। আমার শশুর ধনী ছিল, তাদের বেশ প্রভাব ছিল। আমি সব মেনে নিলাম আর তার বোবা মেয়েকে বিয়ে করলাম। তারপর বিদেশ চলে গেলাম। আমি শুনে বললাম- কত টাকার জন্য নিজেকে বিক্রি করলেন? উনি বলল- পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়েছিলাম। তখনতো পঞ্চাশ হাজার টাকার অনেক দাম ছিলো। তাই আমি নিরুপায় ছিলাম। তারপর বিদেশ থেকে কাজ করে আজ এতো বাড়ি গাড়ি করেছি, এতো ব্যবসা টাকা পয়সা হয়েছে। সবতো ঐ বদৌলতেই, তাই আমি জীবনে ইচ্ছা থাকলেও অন্য কোন মেয়েদের দিকে তাকাতে পারিনি। কারণ আমিতো জেনে শুনেই করেছি এবং এখন তিনটি মেয়ে, ওরাও বড় হয়েছে, আমাদেরও বয়স হয়েছে আর কি বা করবো।
কেউ একটু ভালো কথা বললে সুন্দর করে কথা বললে খুব ভালো লাগে, কথা বলতে ইচ্ছে করে। মনে হয় এটাই যেন পাওয়া, টাকা পয়সা জীবনে কিছুই নয়। আমি আসলে খুব দুঃখী সুখ পেলাম না, ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে না। কারণ ঘরে কোন শান্তি নাই বরং ঘরে গেলেই কষ্ট হয় তাই বাইরে বাইরে কাজেই ব্যস্ত থাকি। তখন সব শুনে আমি বললাম- তবে আপনি সংসার করছেন কিভাবে? কিভাবে দু’জন দু’জনকে বোঝেন? জালাল ভাই বলল- এতো বছর এক সাথে আছি, এখন একজন আরেকজনকে বুঝি, ইশারায় কথা হয়। বুঝার চেষ্টা করে যাচ্ছি আর দিন পার করছি। শুনে খুব বেশী খারাপ লাগলো।
যদিও জানি মুহুর্তের মধ্যেই মনে হলো আসলেই টাকা জীবনের অভাব বা প্রয়োজন পূরণ করতে পারে, জীবনে এই সুখ বা শান্তি গুলোতো দিতে পারে না। সুখ বা শান্তি টাকা দিয়ে কেনা যায় না। টাকা জীবনের অনেক কিছু তবে টাকা জীবনের সবকিছু নয়। বরং টাকাই জীবনে কখনো কখনো অশান্তির কারণ হয়ে যায়, যা হলো জালাল ভাইয়ের জীবনে।
এর পরেও মাঝে মধ্যে জালাল ভাই ফোন দিলে উনার কষ্টের কথা চিন্তা করে উনার সাথে কথা বলতাম। এভাবে প্রায় দু’বছরের মত আমি উনার সাথে কথা বলেছি। তারপর এক পর্যায়ে বুঝিয়ে বললাম- জালাল ভাই আপনি ভালো মানুষ, যা নিয়ে যেভাবে আছেন, তা নিয়েই থাকেন, কি আর করবেন? তবে এভাবে আমার সাথে আপনার কথা বলা ঠিক নয় আর আমিও আপনাকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ তাতে আপনার সংসারে অশান্তি নেমে আসবে, অমনোযোগী হয়ে যাবেন। আমার প্রতি দূর্বলতা বেড়ে যাবে, আমাদের উভয়ের ক্ষতি হবে।
জেনে শুনে আমি এটা হতে দিতে পারি না। তখন উনি নারাজ হলো আস্তে আস্তে আমি উনাকে বুঝিয়ে বললাম এবং কথা বলা কমিয়ে দিতে লাগলাম। এক পর্যায়ে আমি উনার সাথে সম্পূর্ণ কথা বলা বন্ধ করে দিলাম, শুধু উনার ভালোর জন্য। আজ তিন বছর যাবৎ আমি আর কখনোই উনার সাথে কথা বলি নাই। যতটুকু খোঁজ নিয়ে জানলাম উনি ঐ ভাবেই আছে তিন কন্যা আর স্ত্রীকে নিয়েই ভালো আছে। মাঝে খোঁজ নিয়ে জানলাম উনার বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে, উনার স্ত্রী নাকি অসুস্থ। এরপর আর এই দু’বছরে উনার খোঁজ আর আমি নেই নি। হয়তো উনি ঐ ভাবেই ভালো আছে।
তবে যতটুকু বুঝলাম দু’জন একসাথে বসে সুখ দুঃখের কথা বলবে, হাসবে, কাঁদবে, ঝগড়া করবে, রাগ করবে, মান-অভিমান করবে এটাইতো জীবন। কথা না থাকলে তা আসলেই অনেক কষ্টের জীবন। তাই সুন্দর কথার পিছে ছোটা টাকা সাময়িক ভাবে কিছু দিলেও কেড়ে নেয় অনেক বেশী। জেনে শুনে টাকার জন্য কারো জীবন যেন এতো কষ্টের না হয়। অশান্তির না হয়। কারণ টাকা সব নয়। আমরা সবাই তা মনে রাখবো টাকা নিঃসঙ্গতা পূরণ করে না। প্রচুর টাকার মাঝেও মানুষ নিঃসঙ্গ থাকে এটাই তার প্রমান। জীবনের জন্যই টাকা, টাকার জন্যই জীবন নয়। মাঝে মধ্যে আমরা তা ভূলে যাই, যা ভোলা উচিৎ নয়।
কবি ও লেখক