ও' চলে যাওয়ার চার বছর পূর্ণ হতে হয়ে গেল। আমি কখনো ওর কবরে যেতে চাইনি। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি সুনসান কবরের নিস্তব্ধতায় শুয়ে আছে। আমি এই সহজ সত্যটি মেনে নিতে পারি না আজ অব্ধিও। ওর কষ্ট মাখা মুখ, অসহায়ত্ব এখনও দুঃস্বপ্ন হয়ে চোখে ভাসে। ওর নামের আগে মরহুম লাগাতে এখনো ভীষণ কষ্ট হয় আমার।
একজন তরতাজা মানুষ হঠাৎ জানতে পারলো, ওর ডাক এসেছে, ওকে এই মায়াময় পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। মুহূর্তের মধ্যে সব সুন্দর স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হল। সামনে তাকাতে পারি না, কোনো কিছু ভাবতে পারি না। কেবলই অমাবস্যা, কেবলই অন্ধকার।
একটা সময় পর সত্যের মুখোমুখি হই। ওকে বলি, ‘হাতে যে কটা দিন সময় আছে মৃত্যুর কথা নয়, মন খারাপ নয়, চলো আমরা বাঁচার চেষ্টা করি। আনন্দ ফুর্তিতে সময় কাটানোর চেষ্টা করি।’
কথাগুলো বলা যত সহজ, করা ঠিক ততোটাই কঠিন। এক জনের আড়ালে অপরের চোখের পানিতে বালিশ ভেজানো। ভেতরে যত কষ্টই হোক, বুক ফেটে চোখ থেকে বেদনারা বেড়িয়ে আসতে চাক, তারপরো হাসি মুখে বলে চলা, ‘ভালো আছি’।
ডাক্তার প্রথমেই বলে দিয়েছে, গ্ল্যইওব্লাস্তমা গ্রেড ৪, সবচেয়ে খারাপ ধরণের ব্রেইন ক্যান্সার, হাতে সময় খুব অল্প। বড়জোড় ১৫ মাস। সময় নিয়ে ভাবতে ভয় লাগে। রাতে ছেলের বুকে শুয়ে হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠি। আমার বাচ্চাদুটো ভয়ে বুকের মধ্যে সিটকে থাকে। ছোট দুটো বাচ্চা রেখে, আমায় একা ফেলে লোকটা অকালে চলে যাবে! বুকের ভেতরটা মোচড় দেয়, গলা বেয়ে কি একটা দলা পাকিয়ে বেড়িয়ে আসতে চায়। কিচ্ছু বলি না, অসহায় তাকিয়ে থাকি আর ভাবি কি করে কাটাবো আমি ওকে ছাড়া!
ইন্ডিয়া, সিঙ্গাপুর, ইউরোপ, আমেরিকা ঘুরে কোথাও ওষুধ মিলল না, চিকিৎসা হলো কিন্তু কাজে আসলো না। মৃত্যুর মাস তিনেক আগে থেকে হাত পা পেরালাইস হয়ে ও’ প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে গেলো। একজন প্রাণবন্ত মানুষের পক্ষে এই অবস্থা মেনে নেয়া ভীষণ কষ্টকর। আর আমি! আমার আদরের ধন ধূলায় লুটায়। কি যে কষ্ট মানসিক অসহায়ত্ব বলে বোঝাবার নয়।
একটা সময় পর মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হতে শুরু হল ওর। ওর বন্ধু ডাক্তার পপসি ভাই আমায় বলল, ‘মুন্নি, বুঝোই তো কেমো কোনো কাজে আসছে না তবে আর যন্ত্রণা বাড়িয়ে লাভ কি’? আমার স্বামীর মৃত্যু পরোয়ানা আমার নিজের জারী করতে হচ্ছে। আমি ভেতরে ভেতরে মূষরে পরলাম, ক্ষয়ে ভেঙে যেতে থাকলাম, জোড়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হল কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেড় হলো না। ধীর স্থির শান্ত কণ্ঠে বললাম, এই মুহূর্তে ওর জন্য যেটা ভালো হয়, তাই করুন।
ল্যাব এইড থেকে বাসায় ফিরে তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আমার বৃদ্ধ অসহায় মায়ের সাথে মিছেই চরম দূর ব্যাবহার করে ফেললাম। যা কখনো করি না, জিনিস পত্র ভাঙতে থাকলাম, মায়ের সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করা শুরু করলাম। পুরোটাই নিজের অসহায়ত্ব আর বেদনাকে আড়াল করার জন্য মনের অগোচরে করা। কিন্তু মায়ের কাছে সরি বলতে পারলাম না, একবারো বলতে পারলাম না আমার চরম দুর্দশার করুণ ইতিহাস।
ওর হাত পা শরীর সব প্যারালাইজড, নাক দিয়ে কেবল নিঃশ্বাস নিচ্ছে। আমি ওর কপালে গভীর মমতায় হাত রাখলাম, সাথে সাথেই ও নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিলো। যেন হাতের স্পর্শটা পরিপূর্ণ ভাবে অনুভব করতে চাইলো। এটাই ওর সাথে আমার শেষ যোগাযোগ। আমার ভেতরটা সেদিন ডুকরে কেঁদে উঠলো। একজন মৃত্যু পথ যাত্রী অসহায় মানুষ যার শরীরটা পুরোপুরি নিস্তেজ, নিষ্ক্রিয় কিন্তু এখনো পরিপূর্ণ জ্ঞান আছে। ওর কষ্ট অসহায়ত্ব আমার সহ্য সীমার বাইরে চলে গেছে। সারা দেশে যেখানে যে আছে ফোন করে বললাম ওর জন্য দোয়া, মিলাদ পরাও।
এতোদিনে সবাই প্রায় যেনে গেছে ওর বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই। আমার বড় ভাই অসহায় কণ্ঠে আমায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কি দোয়া করাবো’? আমি শান্ত স্বরে কেবল বলতে পারলাম, ‘আল্লাহ্ যেন আমাদের মাফ করে দেন আর ওর কষ্ট কমিয়ে দেন’। পরদিন ৮ই ফেব্রুয়ারি ভোর ৪ টায় সত্যিই আল্লাহপাক ওর কষ্ট কমিয়ে দিয়ে আপন করে নিলো।
হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পথে বিরবিরিয়ে নিজেকেই যেন বললাম ১৫ মাসের ২ দিন আগেই চলে গেলো! ডাক্তার তো বলেইছিল বড়জোর ১৫ মাস। সাথে আমার বাচ্চাদুটো কথা কয়ে উঠলো, ‘আগে আমাদের বলোনি কেন’। যেন আমি ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি ওদের সাথে। আমি কি করে ওদেরকে বোঝাই, কথাটি বলা এতো সহজ ছিল না আমার জন্য।
প্রতিবার ডাক্তারের কাছে ও’ ভীষণ আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করতো, ‘আমার কতোটা সময় হাতে আছে’? ডাক্তার নিষ্ঠুরের মতো উত্তর করতো, ‘৮ থেকে ১৫ মাস’। কেউ যখন জিজ্ঞেস করতো ডাক্তার কি বলেছে, আমার ভীষণ নিষ্ঠুর মনে হতো তাঁদের। আমি ওকে কোনো কথা বলতে দিতাম না, নিজেই তাড়াতাড়ি উত্তর দিতাম, ‘ডাক্তার বলেছে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে’।
ওর মৃত্যুর পর সবাই চিৎকার করে কাঁদছে। কেবল আমি কাঁদছি না। আমি মহান আল্লাহ্ পাঁকের শোকর গুজার করে শেষ করতে পারি না, ‘মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন ওকে কষ্ট থেকে রেহাই দিয়েছে’। আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। ওর পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অনেকেই সেজেগুজে আসছে আর আমার কান্না না দেখে হতাশ হয়ে বলছে, ‘তুমি অনেক শক্ত আছো’। আশ্চর্য ওরা কি দেখে আমার সমালোচনা করছে! ওরা কি অন্তর্যামী! ওরা কি করে জানবে আমার ভেতরের কষ্ট, হতাশা, অসহায়ত্ব, হৃদয়ের গহীনে ভাঙচুর।
সবার প্রকাশ ভঙ্গী, চিন্তা-চেতনা, ধারণ ক্ষমতা এক হবে কি করে। অনুভূতিগুলো মানুষের ব্যক্তিত্ত্ব, শিক্ষা, রুচিবোধ, ম্যাচিউরিটি আর অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। তবে ভালো খারাপ বিচারের অধিকার ওরা কোথায় পেলো? কেবল জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে কাঁদলেই বুঝি ভালোবাসা বেশী হয়! কষ্ট বেশী হয়!
টিংকুহীন চারটি বছর একেবারে কম নয়। এই সময়টুকুর মধ্যে কতো কি যে দেখলাম কতো কি যে শিখলাম। মৃত্যুর পূর্বে ও’ আমাকে সান্ত্বনা আর সাহস দেয়ার জন্য অনেক সময় বলতো, ‘আমার পুত্র তুল্য ভাইকে তোমাদের পাশে পাবে, বিগত ৩০ বছর ধরে ওকে নিজের ছেলের চেয়েও বেশী আদর, স্নেহ দিয়েছি, বিপদের দিনে অমুক ভাই তোমার পাশে থাকবে’। হায়রে ভাই, হায়রে পুত্র! সবাইকে দেখেছি। সারা জীবনে যাদেরকে চিনতে পারিনি, কষ্ট পেলেও তাঁদের রূপ আমার সামনে আজ উন্মোচিত।
স্বার্থের জন্য স্ব স্ব মূর্তিতে তাদের উপস্থিতি আর কুৎসিত চেহারা আমায় জানান দিয়েছে, ‘ডাঃ জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু কতো বড় মাপের মানুষ ছিলেন’। কষ্ট আছে, বেদনা আছে কিন্তু পাশে শান্তিও আছে, আত্ম প্রসাদটুকুন আছে, ‘আমি অনেক হৃদয়বান একজন মানুষকে ভালবেসেছিলাম’। যে কোনো দিন নিজের স্বার্থের কথা ভাবেনি, নিজের স্ত্রী এমনকি সন্তানদের কথাও ভাবেনি, তাঁর চারিপাশের মানুষদের সুখী করতে সদা সচেষ্ট থেকেছে।
মানুষের প্রতি নিজের অঙ্গীকার, কর্তব্য, দায়িত্ববোধ থেকে মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বিন্দু মাত্র পিছপা হয়নি। মৃত্যু দুয়ারে দাঁড়ায়ে জেনেও নিজের সন্তান নয়, পুত্র তুল্য ভাই এবং অন্যান্য কথিত ভাইদের স্বার্থ রক্ষায় সদা সচেষ্ট থেকেছে।
পুত্র তুল্য ভাই, এতিম খানায় বড় হওয়া ছেলেটি যাকে ছাত্র রাজনীতি থেকে আগলে চাকরি দিলো, পরে নিজের সাথে রেখে ব্যবসায় সমান অংশীদার বানালো। এক এগারোর পরে সে কানাডার নিরাপদ জীবনে চলে গেলো। আর টিংকুর কাঁধে ফেলে গেলো সমস্ত ঋণের বোঝা। টিংকুর মৃত্যুর পর আমার বিশ্বাস আর সরলতাকে পুঁজি করে নিজের আখের গোছানোর পর সমস্ত সম্পর্ক মুছে ফেললো নিমিষেই।
আমাদের বিয়ের মাত্র তিন মাস পরে ছেলেটির বিয়ে হয়। টিংকুর বয়স তখন সবে মাত্র ২৯, পর পর দুটো বিয়ে, গহনা কেনার এতো টাকা টিংকু কোথায় পাবে! টিংকুর ভালবাসার আতিশয্যে আমি স্নেহে আপ্লুত হয়ে নিজের সমস্ত গহনা উপহার হিসেবে দিয়ে দিলাম। অথচ বিদেশে একই শহরে থাকলেও সেই ভাই টিংকুর ছেলের বিন্দুমাত্র খোঁজ নেয়ারও প্রয়োজন বোধ করে না কখনো। অনেকবার ওর সাথে বসতে চাইলেও বসেনি, ফোন করলেও ধরেনি। আর টিংকু অন্য যেসব ভাইদের কথা বলতো যাঁদের উপর নির্ভর করতো তারাও লাশ দাফনের পর আর খবর নেয়নি।
টিংকু বেঁচে থাকতে যারা তাকে ঘিরে ফায়দা নিয়েছে তারাই তার সন্তানদের ঠকিয়েছে। কিন্তু মনে শক্তি আছে, মনটা ভরে যায় দেশ বিদেশের অসংখ্য বন্ধু বান্ধব আপনজন যখন খোঁজ নেয়, তাঁকে স্মরণ করে। একবাক্যে বলে, ‘তার আত্মাটা বড় ছিল’। তখন সন্তানদের সাথে আমারো কষ্ট লাঘব হয়। টিংকু বিশ্বাস করতো, ‘সে শুধু পরিবারের নয়, মানুষের’। মানুষই তাকে মূল্যায়ন করছে, তাকে ভুলেনি। ভুলেছে কেবল নষ্ট, স্বার্থপর যারা তার উপর ভর করে অর্থ-বিত্তের পাহাড় গড়েছে, তাকে উপরে ওঠার সিঁড়ি বানিয়েছে।
রাজনৈতিক সহকর্মী, চট্টগ্রামের মানুষ ছিল ওর আত্মার আত্মীয়। চট্টগ্রাম ছিল ওর প্রাণ, পরে থাকতো ওখানেই বেশী। বিশ্বাস করতো রক্তের সম্পর্কই শেষ নয় আত্মার সম্পর্ক অবিনাশী। পরিবারকে দেখত সামর্থ্যের বাইরে। আজ দেখা যায় চট্টগ্রাম বাসীরাই তাঁর সন্তানদের খোঁজ নেয়। নেয় না শুধু যারা দুহাতে তাকে লুটেছে তারা।
স্বার্থান্বেষী লোভী মানুষরা ওর সন্তানদের ঠকাচ্ছে ঠকাক। আমি মানুষ নয়, সৃষ্টিকর্তার শক্তিতে বিশ্বাসী, তার বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তার ইচ্ছায় আস্থাশীল। জীবন দিয়ে জেনেছি মানুষের হাতে কিছুই নেই। অসৎ মানুষরা ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা কেঁড়ে নিয়ে সাময়িক কষ্টের কারণ হতে পারে কিন্তু তার সন্তানদের হৃদয়ের সুখ-শান্তি, মান- সম্মান, চিন্তা-চেতনা, জীবনবোধ, এতো মানুষের দোয়া আর ভালবাসা তা কি করে কেঁড়ে নেবে? এ সবই তো আল্লাহ্র দান তার অসীম দয়া, তার পরম রহমত।
আমি জানি টিংকুর হৃদয়ে বিন্দুমাত্রও মালিন্য ছিল না, স্বার্থপরতা ছিল না, অসততা ছিল না, চিন্তা ধারায় কোনো নীচতা ছিল না। টিংকুহীন জীবনে এটাই আমার বড় সুখ, আনন্দ, একমাত্র পাওয়া, আমার অহংকার।
লেখক- খূজিস্তা নূর ই নাহরীন মুন্নি
বিবার্তা/জাকিয়া