কোনো একটি গ্রন্থ প্রকাশনার কথা ভাবতে গেলে বাংলাবাজারের কথা মনে পড়ে। কেননা বাংলাদেশের অধিকাংশ স্বনামধন্য প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান এখানেই গড়ে উঠেছে। বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত এই বাংলাবাজারের এক সময়কার নামি-দামি কিছু প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান আজ বিলুপ্তপ্রায়। নতুন নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও তার অধিকাংশই কেবল নোট-গাইড প্রকাশ করে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। খুবই সীমিতসংখ্যক প্রতিষ্ঠান শিল্প-সাহিত্যের মানসম্মত গ্রন্থ, গবেষণামূলক গ্রন্থ, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য অবলম্বনে রচিত গ্রন্থ প্রকাশ করে বাংলাদেশের প্রকাশনা-শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এই সীমিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গতিধারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বর্তমান প্রজন্মের অনন্য প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান গতিধারা। দীর্ঘদিন ধরে গতিধারা সৃজনশীল শিল্প-সাহিত্যে মানসম্মত গ্রন্থাদি প্রকাশ করে পাঠকের আকাক্সক্ষা নিবৃত্ত করে চলেছে। এ প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা হলো বাংলাদেশের সমন্ত জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং আঞ্চলিক ইতিহাসগ্রন্থের প্রকাশনার উদ্যোগ। ইতোমধ্যে এ সিরিজের অনেক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যে লক্ষ্য নিয়ে গতিধারা এগিয়ে চলেছে, তাতে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণের পথিকৃতের আসনটি এ প্রতিষ্ঠান অর্জন করবে। আর এর সমন্ত সাফল্যের মূলে রয়েছেন গবেষক-প্রকাশক সিকদার আবুল বাশার। তিনিই এ যুগান্তকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী।
বাশার ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় এক দশক ধরে। এর মধ্যে কিছু সময় বাংলাবাজারের বিউটি বোডিং এবং শ্রীশদাস লেনের একটি বাড়িতে আমার অবস্থানের সুবাদে বাশার ভাইকে খুব কাছ থেকে চেনার সুযোগ হয়েছিল। এ সময় আমি প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় গতিধারায় যেতাম। আর সেখানে গেলে কত বিষয়ে যে গল্প শুরু করে দিতেন, সন্ধ্যা থেকে কোনোদিন রাত ১১টা অবধি চলতো। ভীষণ আড্ডাবাজ মানুষ তিনি। একবার কোনো বিষয়ে কথা শুরু করলে আর থামতেই চাইতেন না।
মানুষকে কাছে থেকে চেনার, মানুষের নানা প্রবৃত্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভের প্রয়াস তার মধ্যে সর্বদা দেখেছি। যাঁর সঙ্গে যে বিষয়েই কথা শুরু হোক না কেন, কথায় কথায় বাশার ভাই তাঁর ইতিহাস-ঐতিহ্য খোঁজার চেষ্টা করতেন। কারণ তিনি মনে প্রাণে চান বাংলার সমন্ত মানুষের ইতিহাস, সমন্ত বাংলার ইতিহাস হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে তা কালের অক্ষরে লিপিবদ্ধ করতে। এর জন্য তিনি বাংলার নানা জনপদে ছুটে বেরিয়েছেন, বিভিন্নভাবে ছড়ানো ছিটানো ইতিহাসের টুকরো টুকরো পাপড়িগুলো তুলে এনে ইতিহাস-মালা রচনার প্রয়াস পেয়েছেন। আর এ কাজে তার সঙ্গে আরো অনেকে যুক্ত রয়েছেন। কেন না একজনের পক্ষে সব জেলার সব জনপদের ইতিহাস-ঐতিহ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে আনা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে সংগৃহীত উপাদানগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে নান্দীপাঠ থেকে যবনিকা পর্যন্ত থাকে বাশার ভাইয়ের সযত্ন প্রয়াস। আর এ জন্য গতিধারার প্রকাশনার মান এ জগতে স্বতন্ত্র স্থান করে নিয়েছে। উল্লেখ্য যে, এ জন্য গতিধারা কয়েকবার শ্রেষ্ঠ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের এবং বাশার ভাই শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদশিল্পীর পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
পুরস্কার, সম্মাননা, যশ-খ্যাতির জন্য দুনিয়া পাগল। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এসবের মাপকাঠিতেই আমরা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণের চেষ্টা করি। আমি বাশার ভাইকে যতখানি চিনেছি, তিনি যশের পাগল নন। তবে সবসময় ভালো কিছু করার চেষ্টা থেকে সরেননি কখনো। এ জন্য আমি তাকে শুধুই একজন বই-প্রকাশক বা গবেষক মনে করি না, বরং তিনি নিজেই একটা বই। পৃথিবীর সমন্ত সম্পদের লয় আছে, কিন্তু একটা বইয়ের মধ্যে যে সম্পদ থাকে তার কোনো ক্ষয় নেই, ধ্বংস নেই।
তাই বাশার ভাই যত্ম করে নিজের সমন্ত রাগ-অনুরাগে সিক্ত করে একেকটা বই প্রকাশ করেন। একটা বই প্রকাশ করার মানে তিনি নিজেকে প্রকাশ করার মতো দেখেন। একজন মা যেমন দশ মাস দশ দিন পেটে ধরে অনেক কষ্ট করে একটি সন্তান জন্ম দেন, বাশার ভাইয়ের প্রত্যেকটি বই প্রকাশনার পেছনে তেমনি শ্রম ও যত্ন ক্রিয়াশীল। তিনি মনে করেন যে, মানুষ চিরদিন বেঁচে থাকে না, বেঁচে থাকে মানুষের ভালো কাজ। তাই ভালো কাজ হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন ভালো মানের বই প্রকাশ করাকে।
সিকদার আবুল বাশার অনেক বড় গবেষক, ইতিহাস সংগ্রাহক ইত্যাদিকে আমি তার পরিচয় হিসেবে দেখি না। আমার কাছে তিনি একজন মানুষ। যে মানুষটি সবসময় বাংলার নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার অংশিদার হতে চেয়েছেন, তাদের জীবন-সংগ্রামের প্রকৃত ইতিবৃত্তকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। একজন মানুষ হিসেবে তিনি সবসময় মানুষের সঙ্গে খোলা মনে মেশার চেষ্টা করেন। ফলে বয়সে ছোট কি বড়, তা বড় ব্যাপার নয়, যে কোনো মানুষের সঙ্গে তার বন্ধুত্বটাও হয়ে যায় খুব সহজে।
সত্যি কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, আজকাল প্রতিযোগিতার যুগে মানুষের হৃদয়বৃত্তির মূল্য কমতে কমতে যান্ত্রিকতার জটাজালে মনুষ্যত্ব জবাই করা মুরগির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে। ভাই ভাইয়ের শত্র“ হিসেবে মারামারি কাটাকাটি করছে, এসব অবস্থা দেখে দেখে সাধারণ মানুষ হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে বেশি করে। এমন হতাশার কালে বাশার ভাইয়ের মতো মানুষেরই বেশি দরকার, কোনো গবেষক বা ঐতিহাসিক নয়। কেন না গবেষক, ঐতিহাসিক শুধু মানুষের সবকিছুকে নির্দিষ্ট ছকে ভাবেন, কিন্তু বন্ধু মানুষ মানুষের সবকিছুকে মন দিয়ে অনুভব করেন। বাশার ভাইও মানুষের সমস্যা, সম্ভাবনা সবকিছুকে মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন।
সিকদার আবুল বাশার গতিধারা পাবলিকেশনের একটা ছোট ঘরে বসেন, কোনো মিডিয়ার কারিশমা ছাড়াই তিনি প্রকাশনাশিল্পে যে কৃতিত্ব দেখিয়ে চলেছেন তা সম্ভব হয়েছে তার বন্ধুসুলভ আচরণের দ্বারাই। আমি মনে করি যে, প্রকৃত শিল্পচর্চার কাজের মূল্যায়ন করার সময় এসেছে, সময় এসেছে আমাদের পুরাতন গ্লানি মুছে ফেলে সোনালি ভবিষ্যৎ গড়ার। বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পে সেই সোনালি ভবিষ্যৎ নির্মাণের গুরু বাশার ভাইসহ সকল প্রকাশক ভাইকে অগ্রিম অভিনন্দন জানাই। বাশার ভাই এবং গতিধারা যে গতিতে আমাদের প্রকাশনাশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তা আরো দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাক এই আজকের প্রজন্মের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও প্রধান (ভারপ্রাপ্ত), বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিবার্তা/মহসিন