গতকালের বাংলাদেশ-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের পর যারা লিখেন, মাশরাফির চেয়ে সাকিব ভালো বল করেছেন, তাদের জন্য করুণা দিয়ে একটি বাস্তবতা ও অনুরাগের লেখা লিখছি।
মাশরাফি ৪ ওভারে ২৯ রান দিয়ে মোহাম্মদ হাফিজের মতো গুরুত্বপূর্ণ পাকিকে ফেরত পাঠিয়েছেন। আর সাকিব ৪ ওভারে ২৬ রান, বিনা উইকেটে। এই ভালো তুলনীয়!
দু’টি প্রশ্ন, আচ্ছা বলুন তো, সাকিব যদি কাল আউট না হতেন তাহলে কী বাংলাদেশ জিততে পারতো? আচ্ছা, প্রিয় সাকিবকে কেউ বা কারা কী নষ্ট করে ফেলছেন? না হলে, তাদের আজো কেনো, লিখতে হয় মুগ্ধতা ছড়ানো সাকিবকে নিয়ে?
১৮ বলে তখন প্রয়োজন ২৬ রানের। আউট হয়ে যাওয়া বলটিও যেনো সোনার মুল্য। স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখছি আরো প্রায় ৩০ হাজার মানুষের সাথে। ততক্ষণে ১১ বলে ৮ রান। তারপর।
আনন্দবাজারের প্রিয় রিপোর্টার গৌতম ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘ঠিক এই সময় গোটা বাংলাদেশের হৃদয় খানখান করে সাকিব আউট হয়ে গেলেন। তার বোধহয় সাময়িক ব্রেন ফ্রিজ হয়ে গিয়েছিল। নইলে জীবিত অথবা মৃত কোনও ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ আমেরকে এই সময় স্কুপ করে! সাকিব এর পর যা করলেন আরও অবিশ্বাস্য। ব্যাট দিয়ে হতাশায় প্রচণ্ড জোর স্টাম্পে মারলেন। ক্ষমা যতই চেয়ে নিন, এর পর ম্যাচ রেফারির ঘরে তার অবশ্যই ডাক পড়া উচিত!’
একটা বাস্তবতা তাই দেখলাম কালকে। ১৩ বলে ৮ রান করে এভাবে সাকিব আউট হওয়ার সাথে সাথে স্টেডিয়ামে একই সাথে দুঃখ ও স্বস্তির মিশ্রণ। এরপর আসবে মাশরাফি। মাশরাফির দল জিতাবে, সব দায় তো, দলের এই পিতারই। এতেই শান্তি। কিন্তু সাকিব আউট হবার পর-যা করলেন, তাতে আমার আশপাশে সাকিবকে নিয়ে যেসব শব্দ উচ্চারিত হলো, তা জঘন্য মাত্রায় ‘বেয়াদবি’ থেকে শত আলোকবর্ষ দূরে।
সমস্যা হলো, দল জিতে গেলেও স্টেডিয়াম থেকে বের হতে থাকা সবার মুখে সাকিবের বেয়াদবি কোন মাত্রায় পৌঁছেছে, ওকে কী করা উচিত-তাই নিয়ে নানামুখী মন্তব্য। খেলা শেষে প্রধানমন্ত্রীর বের হবার পথ নির্বিঘ্ন করতে গেট খোলা হলো না স্টেডিয়ামের। ফলে গেটের সামনে হাজার হাজার মানুষ। যা অবিশ্বাস্য তা হলো, সবাই বলাবলি করছে-সাকিব আউট না হলে মাশরাফি আসতেন না। পর পর দু’টো চার হতো না।
ফলে আবার সেই ২০১২। ২০১২ তে, সেদিনও স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখছিলাম। যারা সাকিবকে কারণে অকারণে হিরো বানিয়ে নিজেদের আখের গোছান; তাদেরকে বলবো, ২০১২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সাকিবের ব্যাটিংয়ের ভিডিওটা আবারও দেখবেন।
যারা সাকিবকে নষ্ট করেছেন বা আরো করতে চান, তারা সম্ভবত ওকে গেইল! অথবা পিটারসেনে! পরিণত করবেন। পরে জাতীয় দলের সাথে না থেকে তিনি একা একা বিভিন্ন দেশে খেলে বেড়াবেন। আর তারা তার সাথে ঘুরে ঘুরে লিখবেন, সাকিব কিভাবে ভাত রাঁধেন। আলু ভর্তা করেন।
অথচ সাকিব আল হাসান আর রাকিবুল হাসানের কথা আমরা কেউ-ই ভুলতে পারি না। আমাদের আগের দলগুলোর অক্ষমতার বেড়া ভেঙ্গে যখন আমরা আজকের বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলাম, তখন সাকিব আর রাকিব আমাদের মন ভালো করে দিতেন।
অনেক ইনিংসকেই সাকিব-রাকিব-রাজিন ১শ আর ২শ’র ঘর পার করে দিয়েছেন। সেই অখ্যাত রাকিব, যেদিন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তার দ্বিতীয় ডবল সেঞ্চুরি করেন, আর সেই সুপারস্টার সাকিব কোনো দেশপ্রেম ছাড়া সেদিন-ই ১৩ বলে ৮ রানের বেশি না করে, ‘বেয়াদবি’ করে মাঠ ছাড়েন। স্টেডিয়ামের দর্শকরা মন্তব্য করেন, ও আসলে বড় পর্দায় দেখছিলই না জিততে হলে দলের কত প্রয়োজন।
এমন আচরণের কারণ কী? কারণ একটাই, যারা দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার আশরাফুলকে নষ্ট করেছেন, তাদের কালো ছায়া এখন সাকিবের উপর। গত ১০ ম্যাচে সাকিবের খেলার ধরণ, তার স্কোর খারাপ হলেও যারা-‘কী হলো সাকিবে’র মতো কোনো কিছু লিখতেও রাজি নন।
শোনা যায়, পাকিস্তান দলে গ্রুপিংয়ের জন্য অচিরেই হয় আফ্রিদি নয়, হাফিজকে শাস্তি পেতে হবে। সাকিবকে নিয়েও ওঠা অভিযোগ, শাস্তি আমরা কম দেখিনি। ভারত ও পাকিস্তান দলের সোনালী দিনের বড় মিয়ারা মাঝে মধ্যেই তাদের দেশের বর্তমান দলের সমালোচনা করেন। এরপর আমরা দেখেছি, তারা শুদ্ধও হন। আমাদের দেশের বড় মিয়া ভাইদের একটু সজাগ হতে অনুরোধ জানাই।
কিছু সাংবাদিক এখন তার সহকর্মীদের বলে রাখেন, সাকিবকে ভালো বলতেই হবে। যারা সাকিবের বই ছাপিয়ে, সাকিবকে কিভাবে বিক্রি করা যায়-প্রতিনিয়ত তাই ভাবেন আর এভাবে ওকে আরো অন্ধকারে ঠেলে দেন। মনে হয়, সাকিবকে স্বাভাবিক করতে তার নিবিড় পরিচর্যা দরকার।
আমাদের কথা, একটা পরীক্ষিত পরিসংখ্যানে এটা প্রমাণিত; এই দেশকে দেয়ার মতো সাকিবের ঝুলিতে আরো অনেক কিছুই জমা আছে। সাকিবকে ভালো বলতেই হবে। তবে, এর আগে সাকিবকে ভালো করতেই হবে।
একজন ক্রিকেট-ভক্ত হিসেবেই এ লেখা; যেখানে আবেগ থেকে গেলো অনেক বেশি। ফলে ভুল ত্রুটি থেকেই গেলো।
লেখক: বোরহানুল হক সম্রাট, গণমাধ্যম কর্মী
বিবার্তা/এম হায়দার