পাকিস্থানের তেইশ বছর অপশাসনের বিরুদ্ধে, সত্তরের ১৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, পূর্ব পাকিস্থানের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয় লাভ করেও যখন ইয়াহিয়া ভুট্টোচক্র বাঙ্গালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করে, তখন বাঙ্গালিরা বুঝে গেছেন, ওদের সাথে আর নয়।
অল পাকিস্তান মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে সকল চেষ্টা করেছেন, যাতে পাকিস্তান ভাঙ্গার দায়দায়িত্ব বাঙ্গালিদের উপর না বর্তায়। জাতির দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহান নেতা ১৯৪৭ এর সেই দেশভাগের পর থেকে বুঝতেন ওদের সাথে হবে না, তাইতো তিনি একের পর এক ধাপ অতিক্রম করে ৬৬ সালে ৬ দফা দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধিকার চেয়েছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান মেলেটারি সরকার দেশ ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র অভিযোগে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতাদের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেন।
৩ জানুয়ারি ১৯৭১ সাল। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের শপথ পাঠ করান। প্রতিদিন দেশের অবস্থা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অর্থাৎ শেষ ফয়সালার দিকে যাচ্ছে। উত্তাল মার্চের প্রথমদিন থেকে হরতাল। এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান, সকাল থেকেই সাড়ে তিন হাত বাঁশের লাঠি নিয়ে ময়দানের দিকে বাঙ্গালিরা ছুটে আসছে। জীবন্ত সাক্ষীদের মতে দুপুরের মধ্যেই পুরো রেসকোর্স ময়দান লক্ষ লক্ষ জনতায় ভরে গেছে। সমগ্রহ জাতি তাকিয়ে আছে মহাকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালির আগমনের দিকে, তিনি কখন আসবেন। তারা অপেক্ষায় আছেন নেতার দৈববাণী শোনার জন্য।
হঠাৎ মাইকে শোনা গেলো, একজন বলছেন, মুজিব ভাই এসে গেছেন। তারপর জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে স্লোগানে তৎকালীন পুরো ঢাকা শহর কেঁপে উঠলো, যার ঢেউ আছড়ে পড়লো টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত।
‘ভায়েরা আমার ’ বলে রাজনীতির মহাকবি শুরু করলেন তাঁর মহাকাব্যের পালা । দেশপ্রেমিক প্রতিটি বাঙ্গালির মনের গহীন থেকে চাওয়া পাওয়া, ইচ্ছা অনিচ্ছার কথাগুলো বলে গেলেন তিনি কবিতার মতো করে। তিনি তার ভাষণে কখনো অনুরোধ, কখনো আদেশ, কখনো হুঙ্কার দিয়েছেন।
‘তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকো বলে’ বাঙ্গালিদের নির্দেশ দিলেন। নিজেদের মধ্যে শত্রুবাহিনী ঢুকে পড়েছে. তাই সতর্ক থাকার কথা বললেন। তিনি বললেন, এই বাংলাদেশে হিন্দু মুসলিম, বাঙ্গালি ননবাঙালি সকলে আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের, আমাদের যাতে বদনাম না হয়! কি সেই দৈব আদেশ!
কারখনার মালিকদের নির্দেশ দিলেন, কর্মচারীদের বেতন দিয়ে দেবার জন্য। একজন রাষ্ট্রনায়কের মতো নির্দেশ দিয়ে বললেন, আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই, আজ থেকে কোর্ট কাচারি আদালত, ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে, দেশ তখন বঙ্গবন্ধুর কথায় চলছে, ইয়াহিয়া নির্বাক। তাহলে দেশের প্রেসিডেন্ট কে?
সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি কিভাবে চলবে, তার নির্দেশনা দিলেন। কেউ যাতে খাজনা ট্যাক্স না দেন তার হুকুম দিলেন। যাতে এঅঞ্চলের মানুষের কষ্ট না হয় তার জন্য বাস ট্রেন লঞ্চ চলার অনুমতি দিলেন কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হবে না বলে নির্দেশ দিলেন।
রক্তপাত না করার জন্য পাকিস্তানি আর্মীদের বললেন, তোমারা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না কিন্তু আমার বুকের উপর গুলি চালানোর চেষ্টা করো না। আবার হুমকি দিয়ে বললেন, সাত কোটি মানুষকে দাবায় রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, কেউ আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবা না ।
নেতা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা দিলেন, মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংরাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।
পৃথিবীতে অনেক নেতা তার নিজ নিজ জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে ভাষণ দিয়েছেন কিন্তু স্থান কালভেদে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক, ভাষণ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণ বলে আমরা দাবি করতে পারি। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন তাঁর গেটিসবার্গের ভাষণের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। আব্রাহাম লিঙ্কনের ওই ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসাবে গন্য করা হয়। আমরা অনেকে তার এই ভাষণটি পড়েছি । ওই ভাষণটির সাথে যদি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের তুলনা করি তাহলে দেখবো, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু একটি নতুন জাতির জন্ম, পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন ভূখণ্ডের আত্মপ্রকাশ, সর্বোপরি একটি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা। যেখানে এক চুল পরিমাণ ভুল করা যাবে না। অর্থাৎ একটি বৃহৎ সামরিক শক্তির সাথে নিরস্র মানুষের যুদ্ধ। সেখানে কিভাবে জয়ী হতে হবে তার দৈব মন্ত্রণা ছিলো সেই ভাষণে। আর আব্রাহাম লিঙ্কনের ভাষণ ছিলো আমেরিকার স্বাধীনতার পরে, বলা যেতে পারে দেশ গঠন এবং এগিয়ে যাওয়ার আহবান।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাষণে কথা ছিলো কাব্যিক। বিশ্বাসে ছিলো জাতীয় চেতনা। বিজয়ী বীরযুদ্ধা সৈনিকদের সর্বাধিনায়কের মতো ত্যাজদিপ্ত নির্দেশ। সাতকোটি মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট। প্রতিজ্ঞায় ছিলো ডু অর ডাই। সংক্ষিপ্ত কিন্তু প্রতিটি শব্দ অর্থবহ। তাইতো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এখন দেশ বিদেশে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও গবেষণার বিষয়।
বঙ্গবন্ধুর পুরো ভাষণটি ছিলো মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি সংক্ষিপ্ত সংবিধান। এই ভাষণটি ছিলো মুক্তিকামী মানুষের জন্য একটি গাইডলাইন। ৭ই মার্চের ভাষনের পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা ছিলো শুধু মাত্র আনুষ্ঠানিকতা ।
লেখক: সভাপতি, ডেনমার্ক আওয়ামী লীগ