আজকাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ লক্ষণীয়। সব ধরনের আর্থ-সামাজিক কাজে নিয়োজিত নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সমাজের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন তথা সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
নারী সমাজের অর্থনৈতিক মুক্তি যে আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অর্জনের অন্যতম চাবিকাঠি তা নিয়ে আজ আর কোনো সংশয় নেই। নারীর প্রতি পরিবারের গৃহস্থালি নির্ভরশীলতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাও তৈরি হয়েছে।
অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বেশ পরিবর্তিত হয়েছে বলা যায়। কিন্তু আমাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন কতটুকু ঘটেছে? বোধকরি গতানুগতিক বিশ্বাসে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি।
অথচ প্রায় একশ বছর আগে বেগম রোকেয়া বলেছিলেন “আমরা যে গোলামের জাতি নই, এ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইবে।” তার মতে নারী-পুরুষ উভয়কেই এই বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। এটা সর্ম্পূণরূপে মনস্তাত্ত্বিক বিষয় এবং এর সঙ্গে একাধিক প্রত্যয় জড়িত। এগুলোর মধ্যে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি অন্যতম।
অথচ আজও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও শুধুমাত্র পারিবারিক চাপের কারণে অনেক মেয়ে বাইরে কাজ করতে যায় না। চাকরি পাওয়ার আগেই যদি মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়, তাহলে তো তার ক্যারিয়ার, তার স্বপ্ন অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ে। তখন তাকে থেমে যেতে হয়। কারণ তা না হলে পরিবারে শান্তি বজায় থাকে না।
অন্যদিকে একজন চাকরিজীবী মহিলার পরিবারজীবন পরিবারের অন্যান্যদের সহযোগিতা ছাড়া অত্যন্ত কঠিন। কেননা তাকে বাইরে অনেক কাজ করতে হয়। ঘরে গিয়ে সে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্রাম নিতে চায়। গৃহস্থালি কাজ করতে গেলে প্রায়শই তা ক্লান্তিকর মনে হয়।
এমন পরিস্থিতিতেই তারা ঘরের সমস্ত কাজ করে। সন্তানদের দেখাশোনা করে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের যত্ন নেয়। অন্যদিকে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের এহেন দায়বদ্ধতা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা গৃহস্থালি কাজে অংশগ্রহণ করে না (এর ব্যতিক্রমও আছে, তবে খুবই কম)।
এর প্রধান কারণ আমদের বদ্ধমূল বিশ্বাস। এখনও গৃহস্থালি কাজকে শুধুমাত্র মহিলাদের কাজ হিসেবে ধরা হয় এবং সুবিধাবাদী পুরুষেরা এসব কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে। বাইরে হয়তো বা পুরুষটি একজন মহিলার অধীনেই কাজ করে, কিন্তু ঘরে এসেই সে হয়ে ওঠে অন্য একজন। স্ত্রীকে দিয়ে ঘরের সমস্ত কাজ করিয়ে নেয়াটাই তখন তার কাছে পুরুষালি দাপট।
কিন্তু পারস্পরিক সহযোগিতা ও দায়বদ্ধতার স্বচ্ছতা ছাড়া কি কোনো সম্পর্ক যথাযথ সুন্দর হয়? হয় না। পরস্পরের বোঝাপড়া, ভালোবাসা ও সহমর্মিতাই সংসারজীবনকে শান্তিপূর্ণ করে তোলে।
বেগম রোকেয়া বলেছিলেন যে, স্বামী এবং স্ত্রীর মনোজগতের সামঞ্জস্য তাদের সম্পর্কের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। স্বামী যখন চন্দ্র-সূর্যের সাথে পৃথিবীর দূরত্ব মাপেন, তখন যদি স্ত্রীটি বালিশের ওয়ারের দৈর্ঘ্য প্রস্থ মাপেন (সেলাই করার জন্য) তবে তাদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার বিরাট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
এমতাবস্থায় দুজনের মধ্যে কেমন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে তা তো ভাবাই যায়। তিনি আরো বলেন যে, যদি একটি গাড়ির দুটি চাকা সমান না হয় তবে কি গাড়িটা সঠিকভাবে চলতে পারবে?
অর্থাৎ দুজনে সমসাময়িক চিন্তাচেতনার অধিকারী না হলে যথার্থ পারিবারিক জীবনব্যবস্থা ব্যাহত হয়। বর্তমান সময়ে শিক্ষার্জনের মাধ্যমে স্ত্রী মানসিকভাবে স্বামীর যথাযথ সঙ্গিনী হয়ে উঠেছে ঠিকই, স্বামীরা পারিবারিক জীবনে স্ত্রীদের সঙ্গী হিসেবে কতটা যথার্থ হয়ে উঠতে পেরেছে তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে বৈকি!
বিবার্তা/কাফী