একজন পিতার অফুরন্ত ভালবাসা, জীবদ্দশায় ভুলবার নয়। ৭০ সালের নির্বাচনে নৌকার মিছিল, সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিশাল এক নৌকা বানিয়ে ঠেলাগাড়ীর উপরে উঠিয়ে শোভাযাত্রা করা হয়। ছোট একজন মানুষ দরকার নৌকার মাঝি হওয়ার জন্য, আমার বয়স ১২, তবে দেখতে ৮/৯ বছরের মনে হয় শরীরের আয়তন লিকলিকে, গায়ে মাংস নাই বললেই চলে।
ছোট থেকেই চঞ্চল ডানপিটে ছিলাম, এলাকার মানুষ আমার দুষ্টুমিতে অস্থির থাকতো, তৎকালীন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির উল্লাহ, আমাকে নৌকার মাঝী হতে বলেন। রশিদ চাচার বাড়ীতে আব্দুল গফুর ও বুলবুল ভাই তুলা দিয়ে দাড়ী-মুছ বানিয়ে হাতে হুক্কা দিয়ে নৌকার বৈঠার কাছে বসিয়ে দেয়, খুরশিদ আলম, লুৎফর রহমান, নাদের খান, মুনসুর কোম্পানি, সাদেক খানও ছিলো সেই মিছিলে।
আমি হাজার হাজার মানুষের করতালিতে আনন্দে আত্মহারা মনের আনন্দে হুক্কা টানছি আর শরীরে নানা অঙ্গভঙ্গি করছি। মিছিল এগিয়ে চলছে রায়ের বাজার ট্যানারি মোড়, ঝিগাতলা, সাইন্স ল্যাবরেটরি, কলাবাগান হয়ে শুক্রবাদ, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর লেকের পাড় দিয়ে মিছিল পশ্চিম দিকে যাচ্ছে, আমার নৌকার ঠেলাগাড়ী বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর উল্টা দিকে লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বঙ্গবন্ধু নিজ বাড়ীর একতলা ছাদে পাইপ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। মিছিলে অগণিত লোক, শ্লোগানে, শ্লোগানে এলাকা একাকার ঢোলের তালে-তালে মিছিল এগিয়ে চলছে বঙ্গবন্ধু আমার অঙ্গভঙ্গি মনোযোগ সহ দেখছেন। মিছিল শেষ হতেই তৎকালীণ সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রমিজ ভাইকে বঙ্গবন্ধু বলেন তোমার নৌকার মাঝিকে নিয়ে এসো। তাড়াতাড়ি আমাকে ঠেলাগাড়ী থেকে নামিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর ভেতরে নিয়ে গেলো। সেখানে আব্দুস সামাদ আজাদ, আব্দুর রাজ্জাক, মেয়র হানিফ সহ অনেক নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু বেগম মুজিবকে এক গ্লাস দুধ দিতে বলে, ওকে এক গ্লাস দুধ দাও। আমি কিছুতেই দুধ খাবো না। অনেকেই অনেক কথা অবাক হয়ে বলছে, কিরে এতোবড় নেতা আদর করে দুধ দিয়েছে তুই খাবি না। আজ পর্যন্ত কেহ না করতে পারে নাই। তুইতো ভাগ্যবান, কেন খাবি না। খা-খা অনেক আদর আবদার কিছুইতে আমি দুধ খাবো না। বঙ্গবন্ধু আমার দিকে একবার তাকিয়ে বলছে তোদের দিয়ে কিছু হবে না, নেতা হবি কেমনে, দাড়ী-মুছ খুলেদে এমনিতেই খাবে। এমন সময় একজন আমার দাড়ী-মুছ খুলে দিলে আমি কান্নায় অস্থির বাজনার তালে তালে মনের আনন্দে এতোক্ষণ যে আমেজে ছিলাম তার জবনিকা দেখে আমি আর কান্না রাখতে পারছি না, অঝরে কেঁদে চলেছি।
বঙ্গবন্ধু আমার কান্না থামিয়ে বলেন, তুমি দুধ খাও তোমার দাড়ী মুছ লাগিয়ে দিবো। আমি আর বিলম্ব না করে একটানে দুধ খেয়ে নিলাম। বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে আমার দাড়ী মুছ লাগিয়ে দিলেন। সবাই চেয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর দিকে। তখন আমার বোঝার বয়স হয় নাই। বঙ্গবন্ধু পিতার আদরে একজন অসহায় শিশুকে স্বযত্নে দুধ খাওয়ালেন, বঙ্গমাতা চেয়ে চেয়ে হাসলেন। অনেক নেতা হাসছেন, আমার বোকার মত আচরণ দেখে।
আমি কি জানতাম এই আমাদের জাতির জনক, এই আমাদের বঙ্গবন্ধু, এই আমাদের মুক্তির দিশারী, স্বাধীনতার প্রতীক, বাঙালীর হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা এনে দিতে পারেন। এনে দিয়েছেন, আমরা মুক্ত। স্বাধীনতার পর এদেশে কত প্রধানমন্ত্রী, কত রাষ্ট্রপতি হয়েছেন এবং হবেন জানি না। তবে হলফ করে বলতে পারি বাঙালীকে, বাংলাদেশকে, বাংলার মানুষকে এত ভালবাসা দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিতে পারবে না। একজন অবুঝ শিশুর মনের কথার বুঝতে পারবে না।
লেখক-মহাসচিব
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি
মোবাইলঃ ০১৭১৪০৮০২১৪
বিবার্তা/মহসিন