সতেরো মাস বয়সের শিশু কন্যাকে রেখে উচ্চ শিক্ষার জন্যে আজ আমি অনেক দূরে অবস্থান করছি। এই দূরত্ব আমাকে যেমন প্রতিনিয়ত কষ্ট দেয় তেমনি আমার সন্তানের অবুঝ হৃদয়েও প্রতিনিয়ত শূন্যতার উপলব্ধি ঘটায়। প্রবাস জীবনে তাই আজ বেশী মনে পড়ছে মাঝি ঈশ্বরীপাটনীর বিখ্যাত সেই উক্তি, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ ।
স্রষ্টা যাদেরকে সন্তানের পিতা মাতা হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে তারা এই উক্তির মর্মার্থ সহজেই উপলব্ধি করতে পারে। দাম্পত্য জীবনে তাই সন্তান হলো পরিপূর্ণতার প্রতীক। সন্তানের সকল দায়ভার প্রকৃতিগতভাবেই পিতা-মাতার উপর ন্যস্ত।
তাই অবধারিতভাবে পিতা-মাতাকে সন্তানের নিরাপত্তা বিধায়ক এবং একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল ভাবা হয়। কিন্তু সম্প্রতি রামপুরার বনশ্রীতে এক নরপশু মাতার গর্ভজাত সন্তানকে নিরাপত্তাদানের বদলে বদ্ধ ঘরে সানন্দে গলাটিপে হত্যা করেছে। তার আচারণ দেখে কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে না, চোখে পড়ে না কোনো মানসিক বিকৃতিও। অর্থাৎ তিনি অতি স্বাভাবিক চিত্তে এমন হীন কর্ম সম্পাদন করেছেন।
মমতাময়ী মা যেহেতু নিজ হাতে সন্তানকে হত্যা করতে পারে তাই আমাদের সমাজের কোথাও শিশুর জীবন নিরাপদ নয়। এর যথার্থ প্রমাণ সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে। হিংসার বশবর্তী হয়ে প্রতিবেশীর হাতে শিশু আহত হচ্ছে, খুন হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে। কখনও কখনও চরম আনন্দের সাথে দল বেধেও এরুপ পাশবিক কাজ করা হয়।
আমরা আজ নর পশু হয়ে জীবন যাপন করছি, যা অতি সহজেই অনুমেয়। মানুষের পাশবিকতা কতটা হিংস্র পর্যায়ে পৌঁছালে এমন হীন কাজ করা সম্ভব হয়? সৃষ্টি জগতের নিকৃষ্ট পশুও এমন কাজ করে না, যা আমরা আশরাফুল মাখলুকাত হয়ে অবলীলায় করতে পারি।
আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যত-এমন বাক্য আমরা শুধু বই-পুস্তকেই পড়ে থাকি, কিন্তু বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে শিখিনি। অল্প দিনের প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি জাপানে শিশুদেরকে কতটুকু প্রাধান্য দেয়া হয়। এখানে একজন মা সন্তান প্রসবের পর আর্থিক সাহায্য পায়, তাছাড়া সন্তানের নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত পরিবারকে সন্তানের ভরণ পোষণ খরচ দেয়া হয়। কোনো পিতা মাতা যদি তার সন্তানকে শাসনের নামে সামান্য চপেটাঘাত করে তাহলে এখানে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিশেষভাবে এখানকার শিশুদের বেড়ে উঠার পদ্ধতিটা সম্পূর্ণভিন্ন যা একটি উন্নত জাতি গঠনে সহায়ক। কোনো কাজে বাইরে বের হলে বাশ পিং এ গেলে শিশুদের চোখে পড়ে, এ সময় দেখি স্কুল পড়ুয়া শিশুরা নির্বিঘ্নে একা একা রাস্তা দিয়ে হেটে স্কুলে যাচ্ছে, একা একা রাস্তা পাড় হচ্ছে। আমাদের দেশে এমন চিত্র চোখে পড়ে না।
আমাদের শিশুদের মাঝেও রয়েছে অপার সম্ভাবনা, যা কাজে লাগাতে হলে সবার আগে আমাদের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে, শিশুদের প্রতি মমত্ববোধ বাড়াতে হবে। বাবা-মা, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন আমরা সবাই যখন শিশুর প্রতি ভালোবাসা দেখাবো, নিরাপত্তা বিধান করবো তখনই কেবল একটি সুদৃঢ় এবং উন্নত ভবিষ্যত জাতি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরী হবে। এজন্যই হয়তো ভারত চন্দ্র রায় গুণাকর তার ঈশ্বরী পাটনী চরিত্রের উক্তির মাধ্যমে আমাদেরকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, রিয়ুকুস বিশ্ববিদ্যালয়, ওকিনাওয়া, জাপান।
বিবার্তা/মহসিন