সোহাগী জাহান তনু ১৯ বছর বয়সের মেয়ে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। যে বয়সে একটি মেয়ে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখে, রঙিন প্রজাপতির ডানায় ভর করে উড়ে বেড়াতে চায়, সেই বয়সে মেয়েটিকে নিজের পড়ার খরচ জোগাড় করার জন্য টিউশনিতে যেতে হতো প্রতি সন্ধ্যায় । চতুর্থ শ্রেণীতে চাকরিরত দরিদ্র পিতার কন্যা বলে তার কোন আক্ষেপ ছিল না । বরং দরিদ্রতাকে ভ্রুকটি করে পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের জীবনকে জয় করার অদম্য চেষ্টা ছিল তার সহজাত বৈশিষ্ট্য।
মৃত্যুর মাত্র দুদিন আগে চা বাগানের সামনে তোলা নিষ্পাপ প্রাণোচ্ছল ছবিটি বুকের ভিতর কামড়ে ধরে। আমার ছেলেরই বয়সীই তো !কি অন্যায় ছিল তনুর? উদারমনা থিয়েটার কর্মী হলেও ইসলামিক রীতি-নীতিতে শ্রদ্ধাশীল তনু নিজেকে সবসময় হিজাবে আবৃত করেই শান্ত এবং নম্রভাবে উপস্থাপন করতো।
কোথাও বিন্দুমাত্র বাহুল্য কিংবা উগ্রতার লেশমাত্র ছিল না। তবে কি কারণে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হলো তাঁকে ? কেবলমাত্র নারী শরীরের জন্য এমন হিংস্রতা! যারা এতদিন নারীর উত্তেজক পোশাককেই ধর্ষণের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন তাঁরা এখন কি বলবেন ? এমন পৈশাচিকতা পশুদেরকেও লজ্জিত করে, ঘৃণায় তাঁদের ভ্রুও বুঝি কুঞ্চিত হয়।
তনুদের বাসস্থান এবং তাঁর টিউশনির স্থান দুটোই কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের ভিতরে। অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি স্থান, সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার যেখানে সংরক্ষিত। অথচ সেখানেই তনুর গলাকাটা মৃতদেহ নগ্ন অবস্থায় কালভার্টের পাশে ঝোঁপঝাড়ের ভেতর পড়েছিলো। নাকে রক্ত, মুখের বাঁপাশে আঁচড়, কানে নখের দাগ, একটু দূরে এক গুচ্ছ মাথার চুল। অদূরেই মোবাইল ফোনটা ছিটকে পড়ে আছে।
পুরো দৃশ্যটা জুড়েই মূলত ধর্ষণের আলামত। সেনানিবাসে রাস্তার প্রতিটি বাঁকে লুকানো ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক মনিটরিং থাকার কথা, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা থাকার কথা । এত কড়া নিরাপত্তার ভিতর কীভাবে দুর্বৃত্তরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে সক্ষম হল? কেন দুষ্কৃতকারীর অবয়ব একটি ক্যামেরাতেও ধরা পড়লো না ? তনুর পিতাকে কেন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা দিতে হল? অনেক প্রশ্ন এখন সবার মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে ।
প্রতিদিন কত শত মেয়ে টিউশনি করে নিজেদের পড়াশুনার খরচ চালাচ্ছে। এটাতো কোন অন্যায় নয় বরং গর্বের । তবে তনুকে কেন এমন নিষ্ঠুর নিয়তি বরণ করতে হল ! অন্যরাও কি এখন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে নিজেদের গুঁটিয়ে নিতে বাধ্য হবে ?
বিচারহীনতার কারণে অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আত্মাহুতির মাধ্যমে বীভৎস মৃত্যুকে বরণ করা যেন নারীর জীবনের নির্মম পরিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে । বিচার হীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরোতে না পারলে দোষী পাষণ্ড এই ব্যক্তিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে না পারলে নারীরা আবার অবরোধ বাসিনী হতে বাধ্য হবে।
অপরাধী যেই হোক যত বড়ই হোক খুঁজে বের করে তাঁকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। প্রমাণ করতে হবে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অপরাধের স্থানটি যেহেতু সুরক্ষিত সেনানিবাস তাই এক্ষেত্রে সুষ্ঠু তদন্তের দায়ভার আরও বেশি করে বর্তায়। নতুবা তনুরা এমন করেই ধর্ষিত হবে, নির্যাতিত হবে আর অভিমান ভরা বুক নিয়ে অকালে ঝরে যাবে ।
লেখক: নারী উদ্যোক্তা ও সমাজসেবক