একটি বয়সে এসে মেয়েরা ভীষণ বোকা বনে যায়, আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে। চিরচেনা জগতটাকে হঠাৎ করেই কেমন অচেনা মনে হয় । জীবনের সমস্ত হিসেব নিকেশ কেমন উলট পালট মনে হয় । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় সত্যিই কি আমি !
কোথায় তুলতুলে শৈশব, বেণীতে দোল দেওয়া দুরন্ত কৈশোর, ছুটন্ত ঘোড়ার মতো টগবগে যৌবন ! কখন কোথায় সব হারিয়ে গেছে জানতেই পারেনি। আয়নাকে রূপ কথার গল্পের মত করে বলতে মন চায়, ‘মিথ্যে করে হলেও বল আয়না আমি এখনো আগের মতোই রূপবতী আছি '।
পাশের মানুষ, কাছের মানুষ সবাইকে কেমন অসহ্য লাগা শুরু করে। তাঁদের ভালো কথাও আর ভালো লাগতে নারাজ। চিকিৎসা সাস্র মতে এই অবস্থাকে বলে নারীর 'মধ্য বয়সের সমস্যা ' বা ' Middle Age Syndrom'। হঠাৎ একদিন নারী বুঝতে পারে সে বিগতযৌবনা।
তাঁর রূপ, যৌবন কেবলই অতীত ইতিহাস। জীবনের সোনালি দিনগুলো আর হাতের মুঠোয় নেই। যে রূপ এবং যৌবনকে ক্ষমতার আঁধার বলে মনে করে এসেছে, চারিদিকে রূপমুগ্ধ দৃষ্টি না দেখে দেখে সে আহত হয়, বিভ্রান্তিতে ভুগে, কাঁদে । সে জানে, বুঝে কিন্তু মেনে নিতে কষ্ট হয়।
নারী এত সহজে হার মানার পাত্র নয়, সে পরখ করা শুরু করে। নিজের সমস্ত লাজলজ্জা, মান- সম্মান ভুলে গিয়ে অন্যের চোখে মুগ্ধতা খুঁজে ফিরে। বার বার সে আহত হয়। বয়সের তারতম্যে হরমোনের প্রভাবে চুলে রূপোলি আভা, চোখের নীচ আর ঠোঁটের পাশে বলিরেখা, গলায় ভাঁজ মেনে নেওয়া অতো সহজ নয়।
আকর্ষণ হারানোর ভয় তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ব্লাড প্রেসার, ডাইবেটিকসসহ নতুন করে নানা অসুখ মাথা চাড়া দেয়। তার সাথে অর্থনৈতিক অথবা একান্ত সম্পর্কে মানসিক টানপোরেন তাঁকে বিষণ্ণ করে তুলে । জীবনের চাওয়া আর পাওয়ার অসংগতি তাঁকে ব্যথিত করে হতাশায় নিমজ্জিত করে ফেলে ।
মানসিক এবং শারীরিকভাবে ভীষণ ক্লান্ত লাগা শুরু হয়। এই বয়সে এসে কোন প্রকার অনিশ্চয়তা, অতিরিক্ত স্ট্রেস সে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে না আর । জীবন মানেই প্রতিনিয়ত নতুনের সাথে সন্ধি করে এগিয়ে চলা। কিন্তু জীবনের মধ্য গগনে এসে অনেকেই মানিয়ে নেওয়ার এবং সমঝোতা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
মধ্যবয়সী নারীদের এই জটিল মনো-দৈহিক রোগ সম্বন্ধে বেশির ভাগ মানুষই উদাসিন কিংবা অজ্ঞ। অজ্ঞতার কারণে বর্তমান সময়কালে চারিদিকে এই রোগ মহামারী আকার ধারণ করছে। আথচ তাঁর ঘরের পুরুষের কোন খবর নেই। ঘরের পুরুষ জানেও না তাঁর অতিপরিচিত আপন মানুষটি আর আগের মত নেই, অচেনা অজানা বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
আমাদের পারিবারিক কাঠামোতে নারীরা সাধারণত ঘরের কাজ এবং পুরুষ বাইরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। জীবনযাপনের এই পর্যায়ে টাকা, অভিজ্ঞতা এবং সময়ের অসম বণ্টনের জন্য পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যাহত হয়ে ভুল বুঝাবুঝির ক্ষেত্র তৈরি করে । অনেক সময় ব্যভিচারী পুরুষ তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ডকে বৈধ দাবি করলেও নারীরা বেঁকে বসে।
এই পর্যায়ে এসে নারীদের জীবনবোধ, তাঁদের ব্যক্তিত্ব ১৮০ ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে নিজেকে পর পুরুষের কাছে সহজ লভ্য করে তুলে। অনেকসময় কন্যাসম মেয়েদের সাথে রূপের অসম প্রতিযোগিতায় প্রেমকাতর নারী মারমুখী হয়ে উঠে । আধুনিক কালে সেলফির সাহায্যে ফেসবুকের কল্যাণে নারীরা আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে অন্যের ইনবক্সে নিজের ছবি পোস্ট দিয়ে প্রলুব্ধ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না।
তাঁদের মনে অন্ধ আক্রোশ, প্রতিশোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। পিতামাতার প্রতি আক্রোশ, স্বামীর প্রতি আক্রোশ, কখনও সন্তান বা নিজের প্রতি আক্রোশ। সঠিক কোন কারণ জানার প্রয়োজন নেই তাঁর। যৌক্তিকতা-অযৌক্তিকতায় ধার আর ধারে না সে। জীবনটা যেন নিজেরই কাছে অসহ্য আর অভিশপ্ত মনে হয় ।
প্রতিটি ধাপেই সে কষ্ট পায়, বিরহে জ্বলে। নারী তখন বেরোনোর পথ খুঁজে, মুক্তি পেতে চায় । জীবনটাকে বদলে ফেলতে চায় নিমিষেই। কখনও কখনও হিংসার আগুনের তীব্র লেলিহান শিখা পুরো পরিবারটিকেই বুঝিবা পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। কিন্তু নারীর ভ্রুক্ষেপ নেই। কারণ সে জানে না সে অসুস্থ । উন্নত দেশে মধ্যবয়সী নারীদের চিকিৎসার জন্য কউন্সিলিং এর ব্যবস্থা আছে।
কিন্তু আমাদের দেশে কেবলই শারীরিক সমস্যাগুলো কন্ট্রোল করার জন্য হরমোন থেরাপি। ইসলামেও আছে এই বয়সে বেশি করে ইবাদত করা এবং রোজা রাখার মাধ্যমে সিয়াম সাধনা করা। বিজ্ঞান বলে খাওয়া দাওয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সুনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং ধ্যানের মাধ্যমে আত্মার মুক্তিই পারে জীবনকে পরিপূর্ণ সুখী করতে ।
লেখক: নারী উদ্যেক্তা ও সমাজসেবক