প্রতিদিন সকালে যখন নিজ কর্মস্থলে আসি, তখন থেকেই শুরু হয়- ‘বাবা কয়ডা টেকা ভিক্ষা দেন’... এই বাক্য, এই দৃশ্য সমাজ-রাষ্ট্রের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। প্রতিনিয়ত আমরা অবলোকন করছি এবং সাধ্যমত সাহায্য-সহযোগিতার চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছি। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন অজুহাতে ও ছলে-বলে কৌশলে ভিক্ষা নিয়ে প্রতিদিনই অন্ধকার জগতে ব্যস্ত থাকে।
একদিন সকালে কর্মস্থলে আসার কিছুক্ষণ পরেই একটি লোক আসলো এবং অতি কাতরতার সহিত ভিক্ষা চাইলো। লোকটার কাতরতা ও আকুলতা দেখে ভীষণ মায়া হলো। আমি বিলম্ব না করে তাকে কিছু টাকা দিলাম। হয়তো আমার মতো এমনিভাবে তাকে অনেকেই টাকা দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত; আমি সেদিনই বিশেষ একটা কাজে যাত্রাবাড়ী যাচ্ছিলাম। বাস থেকে নেমে যথারীতি রাস্তার পাশে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে হাঁটছিলাম। ঠিক তখনই ফ্লাইওভারের নিচে খালি জায়গায় চোখ পরতে খুবই অবাক হলাম। যে লোকটি সকালে আমার কাছ থেকে কাকুতি মিনতি করে কিছু টাকা ভিক্ষা নিয়ে আসলো, সেই লোকটিই এখানে একটা বস্তায় তার অর্ধেক শরীর ঢুকিয়ে মনের আনন্দে নেশার জগতে ডুবে আছে। এটা দেখে তখন খুবই রাগ হয়েছিল।
আবার চিন্তা করলাম, এটাই হয়তো তাদের দৈনন্দিন পেশা। হ্যাঁ, এটা সত্য যে কোন কোন প্রফেশনাল ভিক্ষুকও’ রয়েছে। তারা তাদের পেশা হিসেবে বা অন্য কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা তাদের নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এদের মতো ছিন্নমূল মানুষদের ভিক্ষাবৃত্তির মতো কাজে লেলিয়ে দিয়েছে। ওইসব ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা তাদের সর্দার। যা পায় তারা ভাগ-বাটোয়ারা করে। এটা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক একটি বিষয় বলে আমি মনে করি।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমার জীবনের একমাত্র কামনা বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্য পায়, আশ্রয় পায়, উন্নত জীবনের অধিকারী হয়। তার এই কথার রূপান্তর কিন্তু আমরা তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার ছিন্নমূল মানুষদের নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে দেখতে পাই। তিনি ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধে গত ২ জানুয়ারি-১৬ এক অনুষ্ঠানে ঘরে ফেরা কর্মসূচি, আশ্রয়ন প্রকল্প, প্রশিক্ষণ ও ঋণ দেয়াসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কথা বলেছিলেন।
এই ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার জন্য শেখ হাসিনার নির্দেশে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা বিনা পয়সায় ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে, বিনা পয়সায় ট্রেনিং এবং ঋণ প্রদান করছেন। যাতে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।
ছিন্নমূল মানুষদের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনার এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
এর মধ্যে শুধু সরকার নয় বেসরকারিভাবে কিছু সংগঠন ও এনজিও এদের মত ছিন্নমূল মানুষ এবং যারা ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত তাদের নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এসব সংগঠন ও এনজিওদের ব্যক্তিগত অর্থায়নের মাধ্যমে এসব পঙ্গু, অসহায়, ছিন্নমূল মানুষদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছেন। চলাচল করার স্বাভাবিক ক্ষমতা যাদের নেই তাদেরকে পরিপূর্ণ প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে কাজ করে বাঁচার মানসিকতা তৈরি করছেন।
এসব প্রতিবন্ধীদের মধ্যে অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে কাজ করে বাঁচার অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছেন।
তারা আসলে ভিক্ষাবৃত্তি না করেও কোনো উপায় খুঁজে পায় না। তাদের মতো বিকলাঙ্গ বা পঙ্গুত্ববরণকারী মানুষদের কেউ কাজ দিতে চায় না। আর যখন কাজ করে বাঁচার পথে অগ্রসর হয় তখনও সামনে আসে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা।
অনেকক্ষেত্রে প্রশাসন এইসব প্রতিবন্ধীদের কাজ করে বাঁচার পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তাদের দোকান করতে দেয়া হয় না, যারা ইঞ্জিন চালিত রিক্সা-ভ্যান চালায় তাদের রিক্সা-ভ্যান নিয়ে থানায় নানামুখী হয়রানির শিকার হতে হয়, এদের মতো অসহায় মানুষদের কোনো কোনো সময় শারীরিকভাবেও নির্যাতিত হতে হয়। যা সত্যি দুঃখজনক।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা গরীব, দুঃস্থ, ছিন্নমূল, প্রতিবন্ধী, বাসস্থানহীন মানুষদের কথা সবসময় চিন্তা করেন। তিনি ভাবেন কিভাবে তাদের ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বের করে এনে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়। তিনি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন যা তার এই ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতেই এসব জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের উদয় হয়েছে এবং তিনি এই ভাসমান মানুষদের একমাত্র আস্থার জায়গা হিসেবে বর্তমানে পরিগণিত হয়েছেন।
ইতোমধ্যে এসব প্রকল্পের কাজ সরকার শুরু করে দিয়েছে। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান ও সচেতন মহলকে এসব অসহায় ও পঙ্গু মানুষদের পাশে সাহায্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সজাগদৃষ্টি রাখতে হবে। কোনো প্রতিবন্ধী বা অসহায় মানুষ যাতে হেয়প্রতিপন্ন না হয় সে ব্যাপারে সবাইকে আন্তরিক হওয়া প্রয়োজন।
সাজ্জাদ হোসেন সজীব
সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগর (দ.) ছাত্রলীগ।
বিবার্তা/ইফতি/যুথি