মাত্র পাঁচ বছর আগের ঘটনা। তিউনিসিয়ার বোয়াজিজির কথা হয়তো আমরা এখনও ভুলে যাইনি। বোয়াজিজি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মীও ছিল না। রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতি, স্বৈরতন্ত্র, গণতন্ত্র… এসব কেতাবী ঝুটঝামেলায় সে কখনো জড়িত ছিলো না। কয়েকবার সৈনিক পদে পরীক্ষা দিয়ে সে চাকুরি পায়নি। জীবনের তাগিদার পথে পথে ঘুরে সবজি বিক্রি করতো। তাও আবার রাজধানীতে নয়, বোয়াজিজি সবজি বিক্রি করতো রাজধানী থেকে প্রায় তিনশো কি.মি. দূরে সিদি বৌযিদ নামক স্থানে।
ঘটনাটিও খুব সামান্য, এমনটা আমাদের দেশে ঘটলে আমরাও হয়তো খুব বেশি আশ্চর্য হতাম না। বিনা পারমিটে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে রাস্তায় বিক্রি-বাট্টা করা তিউনিসিয়ায় অনেকটা নিয়মের মতো।বোয়াজিজি রাস্তায় সবজি বিক্রির পারমিট ছিল না, ঘুষ দেবার মতো টাকাও না। হয় পারমিট নয় ঘুষ টাইপের কথা নিয়ে কাটাকাটি, পরে হাতাহাতিতে। পুলিশ শেষমেশ তার জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায়। আমরাও তো হরহামেশা কতো হকারকে পুলিশের লাথিগুতো খেয়ে দোকান নিয়ে, বন্ধ করে দৌড়াতে দেখেছি। বোয়াজিজি গর্ভনরের অফিসে গিয়ে তার জিনিসপত্র ফেরত চায়। কিন্তু সেখানে কোনো লাভ না হলে রাগে-দুঃখে সে পেট্রোল কিনে ঐ অফিসের সামনে (১৭ ডিসেম্বর ২০১০) গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। রাজন, সামিউল, তনু বা শ্যামল কান্তিদের ঘটনার সাথে তুলনা করলে বোয়াজিজির ঘটনাটি জঘন্যতার মাপকাঠিতে খুব বেশি কিছু মনে হবার কোনো কারণ নেই।
ব্যস, এতটুকুই। গায়ে আগুন লাগিয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকা ছাড়া বোয়াজিজিকে আর কিছু করতে হয়নি। স্থানীয় জনগণ এ ঘটনায় রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলন মফস্বল থেকে মফস্বলে ঘুরতে ঘুরতে রাজধানীতে পৌঁছায়। এর মধ্যে বোয়াজিজি ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিচারের দাবি কখন যে সরকার পতনের দাবিতে বদলে গেছে তা কেউ বলতে পারে না। মাত্র এক সপ্তাহে রাস্তায় ঘটা সেই ঘটনা এক গণবিক্ষোভে রূপ নেয়, নাম ‘জেসমিন বিপ্লব’।
তিউনিসিয়ার সরকার কোনো ঠুনকো সরকার ছিল না। একটানা বাইশ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল প্রেসিডেন্ট বেন আলী। সর্বশেষ ২০০৯ সালেও বেন আলী নব্বই শতাংশ ভোটে পুনঃনির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসে। তাঁর শাসনামলে তিউনিসিয়ার জিডিপি তিন গুণ বৃদ্ধি পায়, প্রবৃদ্ধির হার ছিল পাঁচ শতাশের উপরে। দারিদ্যের হার ৭.৪ শতাংশ থেকে কমে ৩.৮ শতাংশে (২০০৫) পৌঁছায়।
২০১০ সালে বোস্টন কনসাল্টিং গ্রপের এক রিপোর্টে (The African Challengers: Global Competitors Emerge from the Overlooked Continent) তিউনিসিয়াকে আফ্রিকার অন্যতম অর্থনৈতিক “সিংহ” হিসেবে খ্যাতি দেয়। সে বছরের ড্যাভোস ওর্য়াল্ড ইকোনোমিক ফোরামের গ্লোবাল কমপিটিটিভনেস রিপোর্টে আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে তিউনিসিয়ার অবস্থান ছিল প্রথম। দেশটির অর্থনৈতিক দূর্বলতার মধ্যে প্রধানতম ছিল তরুণ বেকারত্ব (১৩.২৯ শতাংশ, ২০০৯)। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশ হিসেবে এ হার যে খুবই আশঙ্কাজনক তা নয়।
দেশটিতে তখন অন্য কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতাও ছিল না। এক কথায়, ২০১০ সালে তিউনিসিয়া মোটামুটিভাবে একটি শান্ত দেশ ছিল।
বোয়াজিজির আত্মননের চেষ্টা ও অবশেষে জানুয়ারির চার তারিখে (২০১১) তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সামাজিক বিক্ষোভ কাঁপিয়ে দিয়েছিল আরব বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রকে। একে একে এ বিক্ষোভ গণতন্ত্র কায়েমের বিপ্লবের রূপে মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, ইরাক, আলজেরিয়া, সুদান, জর্ডান, সৌদি আরবেও ছড়িয়ে পড়ে। এই বিপ্লবের নাম ‘আরব বসন্ত’।
বোয়াজিজি ঘটনার পরে মাত্র সাতাশ দিনের আন্দোলনে বেন আলী সরকারের পতন ঘটে। এত দ্রুত পতনের অন্যতম কারণ ছিল বেন আলী সরকারের অতি আত্মবিশ্বাস ও সেই অলীক আত্মবিশ্বাসের জোরে বিক্ষোভের উপর দমননীতির প্রয়োগ; এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহ-ফেসবুক, হোয়াটঅ্যাপ, টুইটার ইত্যাদিতে জোরালো প্রচার। শুধু জেসমিন বিপ্লব নয়, পুরো আরব বসন্ত দ্রুত বিস্তরের পিছনেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। নতুন সরকারের আমলে গত পাঁচ বছরে তিউনিসিয়া বড় ধরনের কোন অগ্রগতি তো পায়ই নি, বরং দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা এখন অনেক বেশি নাজুক।
সরকারের পরিবর্তন হয়েছে, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি; ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ, দেশের সেইসব আপামর জনসাধারণ যারাই একদিন পরিবর্তনের নেশায় রাজপথ সরগরম করে তুলেছিল।
রাজন, সামিউলের মৃত্যু, তনুর মতো নারীদের ধর্ষণ, হত্যার উদাহরণ বাংলাদেশে কম নেই। গুলিতে গর্ভের শিশুর মৃত্যু, সরকারী কর্মকর্তাকে হাসপাতালে প্রেরণ, সাগর-রুনির রহস্যজনক মৃত্যু, ম্যাটিস্ট্রেট কর্তৃক শিক্ষককে হেনস্তা, মাইক্রোবাসে/পাবলিক বাসে বলপূর্বক গৃহকর্ম…এমন অনেক ঘটনারই তদন্ত হয়েছে, বিচার হয়েছে বা চলছে; তবুও এদের পুনরাবৃত্তি বন্ধ নেই।
শ্যামল কান্তির মতো শিক্ষক অপমানের হাফ ডজন ঘটনার উল্লেখ করাটাও দুঃসাধ্য নয়।তনুর পুনরায় ময়নাতদন্ত হয়েছে, শ্যামল কান্তিকে চাকরিতে পুনঃবহাল ও স্কুল কমিটিকে বাতিল করা হয়েছে। তবে এ সকল ঘটনা ও সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের মাঝে যে সময়টুকু থাকে সে সময়ে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে যে ঘূর্ণিঝড়ের আর্বিভাব ঘটে সেটাকে সময়মত গুরুত্ব না দেয়া সুবিবেচ্যনাও হতে পারে। আমাদের তো আবার আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি নেই।
শ্যামল কান্তির ঘটনায় লক্ষ্যণীয় হলো ইসলামকে টেনে এনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা। আমরা কি নিশ্চিত যারা যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসির বিরুদ্ধে আন্দোলন জমাতে পারেনি তারা এ রকম কোনো ইস্যুর ছায়াতলে সমবেত হচ্ছে না? যুদ্ধাপরাধদের নগ্ন চেহারার চেয়ে ধর্মের মুখোশ অনেক বেশি শক্তিশালী। যদি শ্যামল কান্তির ধর্মবিরোধী কোনো বক্তব্য প্রমাণিত হয় তবে প্রচলিত আইনে তার বিচার হওয়া উচিত; কিন্তু, কানধরা অনুষ্ঠানকে জায়েজ করার জন্য ইসলামের বিরুদ্ধে কথিত বক্তব্যকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করাকে কোনোভাবেই প্রশয় দেয়া ঠিক নয়। আজ যদি কানধরা জায়েজ হয়, কাল তবে ধর্মের কটূক্তিকারীর হত্যাকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা কোনো ধর্ম নিয়ে কটূক্তি যেমন চাই না, ঠিক তেমনিভাবে অযাচিত কোনো কটূক্তিকারীর চাপাতি থেরাপিও চাই না।
বোয়াজিজি ছিল আরব বসন্তের কোকিল। তনু, শ্যামল কান্তিরা যেন কোনো সর্বনাশের কোকিল না হয়।
লেখক: মো. আলাউদ্দিন ভুঁইয়া; কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (রাজনৈতিক)
বিবার্তা/জিয়া