১৯৭১ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশকে ঘুরে দাঁড়াতে একসময় তাকিয়ে থাকতে হয়েছে বহির্বিশ্বের দিকে। এই দেশকে তখন তাচ্ছিল্য করে তারা আখ্যা দিয়েছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। সেই বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে খাদ্যশস্য অন্য দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। অনাহারের দেশ, দারিদ্রের দেশ নামে একদা পরিচিত বাংলাদেশের জন্যে এটা বিশাল অর্জন।
কিন্তু এই সাফল্য আজকের থানচিতে এসে যেন দিক হারায়, নত হয়, লজ্জিত হয়। বলছি এই কারণে, ইতিমধ্যে সংবাদটি নিশ্চয়ই অনেকের নজর কেড়েছে, ‘বান্দরবানের থানচিতে খাদ্যসংকট এখন চরমে।’
আজকের এই সময়ে এসে এমন সংবাদ দেখে খানিকটা থমকে যেতে হয়। কেন নয়? আমরা যে প্রায় ভুলতে বসেছিলাম উত্তরবঙ্গে মঙ্গাকবলিত এলাকায় বছরের একটি সময় খাদ্যসংকট থেকে স্থানীয় মানুষদের বাঁচাতে লঙ্গরখানা খোলা হতো। দারিদ্র্য থেকে উত্তরণে সরকারের চলমান সাফল্যে সেই লঙ্গরখানা খোলার কাহিনী আজ ইতিহাস।
ঠিক এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের পার্বত্য উপজেলা থানচিতে খাদ্যসংকট ও মানবিক বিপর্যয়ের সংবাদ আমাদের সত্যিই ভাবিত করে। থানচি কি তবে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো জনপদ?
থানচির দুর্গম রেমাক্রি, তিন্দু, ছোট মদক, বড় মদক ও সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্ট; মূলত এসব এলাকায় খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় ত্রিপুরা, ম্রো ও মারমা সম্প্রদায়ের বাস। গত বছরের খারাপ আবহাওয়ায় জুম-ফসলের ফলন ভালো না হওয়ায় চলতি বছরের মার্চ থেকে খাদ্যসংকটে পড়েছে দুর্গম এসব এলাকার অধিবাসীরা। এসব এলাকার ৯৫ শতাংশ মানুষ জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল।
পাহাড়ে জুম চাষের মাধ্যমে তারা সারা বছরের ধান সংগ্রহ করে রাখেন। কোনো কারণে ভালো ফলন না হলে, ইঁদুরের আক্রমণ ঘটলে বা বন্যা দেখা দিলে বছরের খাদ্য মজুদ করা সম্ভব হয় না। ফলন ভালো না হওয়ায় খাদ্যসংকটে পড়েছে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পরিবার।
সংবাদগুলো থেকে জানতে পারি, অনেকে ভাতের অভাবে জংলি আলু, মিষ্টি কুমড়া, আলেয়া (কলা গাছের কাণ্ডের নরম অংশ) খেয়ে ক্ষুধা মেটালেও বেশিরভাগ মানুষ রয়েছেন অনাহারে।
একসময় পার্বত্য এলাকাজুড়ে ছিল অশান্ত পরিবেশ। সবার ঘরে ঘরে ছিল অবৈধ অস্ত্র। মারামারি খুনোখুনি লেগেই থাকতো। বলতে গেলে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি জনপদ ছিল পার্বত্য তিন জেলা - বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি। সেই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে পার্বত্যবাসীকে রক্ষার জন্যে শান্তিকন্যা রূপে এগিয়ে এসেছিলেন শেখ হাসিনা।
১৯৯৮ সাল। তিনি তখন প্রথমবার রাষ্ট্রক্ষমতায়। পার্বত্য শান্তি চুক্তির উদ্যোগ নিয়ে এবং চুক্তি সম্পাদন করে তিনি সেই এলাকায় শান্তি ফিরিয়েছেন। ঠিক এই কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু পার্বত্যবাসীর কাছে নয়, শান্তিকন্যা হিসেবে বেঁচে থাকবেন সবার মাঝে।
কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনার শান্তি চুক্তির এলাকাধীন থানচিতে আজ চলছে তীব্র খাদ্যসংকট।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, খাদ্যের এই সংকট আগামী অক্টোবর পর্যন্ত থাকতে পারে। তাই বলছিলাম, দয়া করে আপনি এদিকে বিশেষ নজর দিন। নতুবা যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, তা আরো খারাপ রূপ নিতে পারে।
জনগণ হিসেবে আমরা চাই, দারিদ্র্য ও ক্ষুধার যে কলঙ্ক থেকে বেরিয়ে এসেছে আমাদের প্রিয় দেশ, সেই কলঙ্ক কোনোভাবে যেন আবার আমাদের আর স্পর্শ করতে না পারে।
লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।