একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত প্রতিবেদন নিয়ে বর্তমানে বেশ আলোড়ন চলছে। যেহেতু সদ্য এসএসসি পাশ করা শিক্ষার্থীরা এখনও শিশু-কিশোর। শিশুদের নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখির সুবাদে বেশ কয়েকবছর যাবত মফস্বলের সংবাদকর্মীদের শিশু বিষয়ক রিপোর্টিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছি। সেই আলোকে কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা এই মুহূর্তে সমীচীন মনে করছি।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ১৭ নং ধারায় প্রচার মাধ্যমের কর্মীদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
বলা হয়েছে: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহের অধিকার শিশুর রয়েছে। সরকার শিশুর এই অধিকার নিশ্চিত করবে। যে সব তথ্য শিশুর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য উপকারী সরকার তা প্রচারের জন্য গণমাধ্যমকে উৎসাহিত করবে এবং ক্ষতিকর উপাদান থেকে শিশুকে রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নেবে।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্ট কর্তৃক শিশু বিষয়ক সংবাদ তৈরির নীতি সম্পর্কিত নির্দেশিকায় বলা হয়েছে-
১. শিশু সম্পর্কিত রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে যথাযথতা ও সুক্ষ্ম প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে পরম উৎকর্ষতা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
২. অনুষ্ঠান নির্মাণ ও ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে মিডিয়ায় জোর করে এমন কিছু উপস্থাপন করা ঠিক হবে না, যা শিশুর জন্য ক্ষতিকর।
৩. শিশুর উপর রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা সংক্রান্ত ত্রিমাত্রিক ও রোমাঞ্চকর বা উত্তেজনাপূর্ণ উপস্থাপন পরিহার করতে হবে।
৪. শিশু সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়বস্তু উপস্থাপনের আগে তার পরিণতি বা ফলাফল সম্পর্কে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করুন। যাতে শিশুর ক্ষতি কম হয়।
৫. জনস্বার্থ ছাড়া সচিত্র বা অন্যভাবে শনাক্ত করা থেকে শিশুদের রক্ষা করুন।
৬. ছবি গ্রহণে নিরপেক্ষ, খোলামেলা ও সরল সোজা পদ্ধতি ব্যবহার করুন এবং যেখানে সম্ভব শিশুকে জানিয়ে তার নিজের বা তার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি, অভিভাবক বা তত্ত্বাবধায়কের মত নিয়ে ছবি সংগ্রহ করুন।
ইউরোপিয়ান হেলথ কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক কর্তৃক গাইডলাইন-এ বলা হয়েছে-
১. প্রথমেই চেষ্টা করুন আঘাত না করতে। মানব কল্যাণ ও মানবাধিকার সবার উপরে।
২. সত্য গ্রহণ করুন। আপনার তথ্যসূত্রগুলো ভালোভাবে লক্ষ্য করুন। ঠিকমতো সংবাদ পৌঁছতে না পারা সত্ত্বেও।
৩. নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনার এই প্রতিবেদনের ফলে কে বেশি লাভবান হবে।
৪. ব্যক্তিগত উৎসাহ উদ্দীপনা পরিহার করুন। সবসময় এটি স্পষ্ট করে তুলুন যে, এক ধরনের অঙ্গীকার থেকেই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হচ্ছে।
৫. তথ্যসূত্রের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা বজায় রাখুন।
৬. অসুস্থ, অক্ষম এবং তাদের পরিবারবর্গের গোপনীয়তা রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট থাকুন।
৭. আপনার প্রতিবেদনের ফলাফল সম্পর্কে সজাগ থাকুন। মনে রাখবেন যে ব্যক্তিটি এখন রোগাক্রান্ত বা অক্ষম, বিশেষ করে শিশু, সে এরপরও দীর্ঘদিন জীবন যাপন করবে- গণমাধ্যম তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলার পরও।
একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় পরিহার করতে হবে। বিয়োগ, ব্যথাতুর বা শোক সন্তপ্ত মানুষের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। বিশেষ করে বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে। সম্ভব হলে ঘটনার শিকার ব্যক্তি বা তার পরিবারের সদস্যদের ক্লোজআপ ছবি বা টেলিভিশন ফুটেজ ধারণ পরিহার করুন।
শিশুদের ওপর নীতিভিত্তিক রিপোর্টিংয়ে জাতিসংঘ ও ইউনিসেফের দিকনির্দেশনা-
১. যেকোনো অবস্থায় শিশুদের অধিকার ও মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখতে হবে।
২. শিশুদের ওপর প্রতিবেদন তৈরি বা তাদের সাক্ষাতকার নেয়ার ক্ষেত্রে শিশু অধিকারের প্রত্যেকটি শর্তের দিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে এগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা ও গোপনীয়তা সুরক্ষিত থাকে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের মতামত জানা, তাদের ব্যাপারে নেয়া সিদ্ধান্ত সমূহে তাদের অংশগ্রহণ এবং প্রতিবেদনের ফলে যেকোনো প্রতিশোধমূলক বা ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়া থেকে তাদেরকে নিরাপদে রাখার নিশ্চয়তা।
৩. যেকোনো বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিটি শিশুর সর্বোচ্চ স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে শিশু অধিকার বাস্তবায়ন এবং শিশু বিষয়ে অতিকথন বা প্রচারণার সমস্যাগুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে।
৪. শিশুর সর্বোচ্চ স্বার্থের বিষয় নির্ধারণের সময়ে, যে সমস্ত অধিকার বিবেচনায় আসবে সেগুলোর মূল্যায়নে শিশুর বয়স এবং সে অনুপাতে তার পরিপক্কতা আছে কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে।
৫. শিশুর জগৎ সম্পর্কে যারা সবিশেষ ওয়াকিবহাল এবং এ বিষয়ে বিচার বিবেচনার ক্ষমতা রাখেন, শিশু বিষয়ক কোনো প্রতিবেদন করার আগে এর বিভিন্নমুখী সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে নিতে হবে।
৬. এমন কোনো রিপোর্ট বা ছবি ছাপাবেন না, যা কোনো শিশু বা তার আত্মীয়-বন্ধুর জন্য বিপদেও ঝুঁকি বয়ে আনে। এমনকি পরিচয় গোপন রেখে, অস্পষ্ট রেখে বা ভিন্ন পরিচয় বহন করেও এধরনের রিপোর্ট ছাপাবেন না।
বিবার্তা/মৌসুমী/কাফী