প্রিয় বাবুল
কেমন আছো? কি বোকার মতো প্রশ্ন করলাম তাই না? জানিতো তুমি ভালো নেই। আমাকে ছাড়া তুমি একটুও ভালো নেই। জানো, আমি না বুঝতেই পারিনি তোমার সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হবে না। আর কোনদিন কথা হবে না। তোমার সাথে ১৬ বছরের সংসার। আরও অন্তত একশো বছর একসাথে থাকার ইচ্ছা ছিলো। হলো না। পারলাম না। আমাকে ক্ষমা করো।
আমরা দুজনেই ছিলাম তুমুল ব্যস্ত। তুমি শহরটাকে নিরাপদ রাখতে আর আমি সংসারের শত কাজে। বাচ্চাদের দেখাশোনা, বাজার, রান্না আরো হাজারো কাজের চাপে দিন যে কেমন করে কেটে যেতো বুঝতেই পারতাম না। আর এখন! এখন শুধুই অবসর। এখানে দিন নেই। রাত নেই। সময়ের সীমা পেরিয়ে এখন আমি অসীমে বাবুল!!
এই চট্টগ্রামে কতোগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম আমরা তাই না!! আমাদের মাহির আর তাবাসসুমের জন্ম তো এই শহরেই। তুমি বলতে চট্টগ্রাম আমাদের পূর্ণ করেছে। আর তাই এই শহরের প্রতি তোমার একটা অন্যরকম ভালোবাসা কাজ করতো সবসময়। শহরের মানুষগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে ভেবেছো। নিজের কথা ভাবোনি। মনে আছে তোমার? একবার জামালখান মোড়ে একদল ছিনতাইকারীকে ধরতে তুমি একাই নেমে পড়েছিলে নোংরা ড্রেনে? যে ড্রেনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মানুষ নাকে রুমাল চাপা দেয়, সেই পঁচা কাদা আর দুর্গন্ধ আবর্জনায় নামতে তুমি একবারও ইতস্তত বোধ করোনি। বরাবরই এমন ছিলে তুমি। সততা আর সাহসিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছো সারাজীবন। আজ খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়- হে আমার অসীম সাহসী বন্ধু, আন্তরিকতা সততা আর সাহস কি আসলে বোকামী!!!
সেদিনের ভোরটা অন্য যেকোন ভোরের মতোই ছিলো। আমি যে আর কোনদিন সকাল দেখব না বুঝতে পারিনি। এই পৃথিবী থেকে যে আমাকে চলে যেতে হবে বুঝতে পারিনি। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মেয়েটাকে যে শেষবারের মতো দেখছি তাও মনে হয়নি। মাহিরকে স্কুলের জন্যে তৈরি করে বাসা থেকে বের হলাম। আমি ওর হাতটা ধরে আছি। এই হাতটা যে আমি আর কোনদিন ধরতে পারবোনা, হায় আল্লাহ একবারের জন্যেও বুঝতে পারিনি!!!
যে শহরটাকে তুমি আমাদের শহর বলতে, যে শহরটা তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার পরিবারকে নিরাপত্তা দেবে ভেবেছো, অবাক ব্যাপার সেই শহরেই ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিলো আততায়ী। ওরা আমাকে মেরে ফেললো বাবুল। ওরা আমাকে বাঁচতে দিলো না। আমার মাহির!! আমার তাবাসসুম!! আমার তুমি!! সবাইকে ফেলে চলে আসতে হলো এই না ফেরার দেশে। আচ্ছা বাবুল, মাহির কি সব দেখেছে? ওতো রক্ত দেখলে খুব ভয় পায়!! সূচ ফুটিয়ে রক্ত নেবে এই ভয়ে ছেলেটা ডাক্তারের কাছেই যেতে চায় না। কোরবানির সময় কান্নাকাটি আর দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। তোমাকে কতবার প্রশ্ন করেছে -কেনো এভাবে পশু জবাই করতে হবে? ও মাকে রক্তে ভেসে যেতে দেখেছে তাই না বাবুল? খুব কাছ থেকে, নিজের চোখে ও মাকে খুন হতে দেখেছে। ও কি আমাকে দেখে কোরবানির পশু ভেবে ভয় পেয়েছে? আমাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে? ওকে যদি বলতে পারতাম, বাবা চোখ বন্ধ করে থাক। দৌড়া, জোরে খুব জোরে আরো জোরে দৌড়া। এই শহর ছেড়ে পালা। এখানে মানুষের বেশে লুকিয়ে থাকে দানব। পারলাম না বলতে। সময়ই পেলাম না। ওরা আমাকে সময় দিলো না বাবুল। শেষবার তোমার হাতটা যদি একবার ধরতে পারতাম। শুধু একবার!!
তোমাকে কি কখনো বলেছি, প্রধানমন্ত্রী যেদিন তোমাকে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বিপিএম পরিয়ে দেয়ার সময় মুচকি হেসে পিঠ চাপড়ে দিলেন টুপুস করে আমার চোখে পানি চলে আসলো। মনে হচ্ছিলো আসলে তুমি না, ওখানে আমিই দাঁড়িয়ে আছি। তোমাকে না, প্রধানমন্ত্রী আদর করে আমারই পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন। তোমাকে নিয়ে আমার গর্বের শেষ ছিলো না। তোমাকে কি কখনো বলেছি সে কথা? কিন্তু আজ বলছি, পালাও। পালাও এই শহর থেকে। আমার ছেলে মেয়েগুলো নিয়ে পালাও। এখানে প্রিয়মানুষের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকে রাস্তায়। এখানে মৃত্যু ওঁৎ পেতে থাকে পাকা শিকারীর মতো। মানুষের জন্যে নিজের জীবন বিপন্ন করো না। স্বার্থপর হও। ভীতু হয়ে বাঁচো। তবু বেঁচে থাকো। আমার মতো মরে যেয়োনা বাবুল। দেখলে তো যে শহরের জন্যে নিজের জীবন বিপন্ন করেছো বারবার, সেই শহর কি প্রতিদান দিলো তোমাকে? এখনো বিশ্বাস করো তোমার মিতু হত্যার বিচারে ফুঁসে উঠবে চট্টগ্রাম? এখনো বিশ্বাস করো যতদিন খুনীরা ধরা না পড়বে ততদিন শান্তিতে ঘুমাবেনা তোমার প্রিয় শহর? তোমার বিশ্বাসের জয় হোক। আমিও অপেক্ষায় আছি।
আমার জন্যে কষ্ট পেয়ো না। আমি তোমার সাথেই আছি। কোন বিষণ্ণ বিকেলে আমার স্পর্শ অনুভবের ব্যাকুলতায় মন কেমন করলে খোলা বারান্দায় সময় করে একটু বসো। মৃদু হাওয়া হয়ে তোমাকে ছুঁয়ে যাবো।
তোমার মিতু।
লেখক: লিটন বাশার, গণমাধ্যম কর্মী
বিবার্তা/মৌসুমী