আন্তর্জাতিক পাবলিক সার্ভিস ডে, বঙ্গবন্ধু, ডিজিটাল বাংলাদেশ : আত্ন-সমালোচনা ও আত্ন-স্বীকৃতি এবং আগামীর পাবলিক সার্ভিস ডেলিভারি বিগত ৬ মাস বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে অনেক বার শুনেছি এবং শুনে শুনে যে বিষয়টি রপ্ত করার চেষ্টা করেছি ; সেটা হলো আমরা যারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত তারা হলাম Public/Civil Servant, মানে রাষ্ট্রের সব জনগণের কর্মচারী।
পাশাপাশি সিনিয়র এক স্যারের যুগান্তরারী যে উক্তিটি আমার মস্তিষ্কে গাঁথার চেষ্টা করেছি : We are civil to none but evil to everybody এই Trend থেকে এই প্রজন্মের কর্মচারীদের বেরিয়ে আসতে হবে।
এবার যাওয়া যাক ভিন্ন প্রসঙ্গে। মহান সংবিধান আমাদের সর্বোচ্চ আইন ।প্রজাতন্ত্রের সব কর্ম ও সিদ্ধান্ত এই সংবিধান থেকেই সঁচারিত। আর প্রজাতন্ত্রের সব কর্ম সম্পাদনের জন্য নিয়োগ করা হয় বিভিন্ন গ্রেডের (বর্তমান পে-স্কল অনুসারে কোন শ্রেণী নেই) কর্মচারী। (মহান সংবিধান ও অন্যান্য আইনে কোথাও কর্মকর্তা বলে কোন শব্দ নেই)। উপমহাদেশে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে জনসাধারণের অভিজ্ঞতা ও ধারণা কখনোই ইতিবাচক ছিল না। কারণ, বৃটিশরা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ করেছিল সে সব মানুষকে যারা সাধারণ মানুষকে শোষণের মাধ্যমে বৃটিশ রাজের কর আদায় নিশ্চিত করতো।
ইতিহাস বলে, তারা যতটা না সেবক ছিল তার চেয়ে বেশী ছিল নির্যাতনের প্রতিমূর্তি। তাছাড়া, পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠী সে সব কর্মে নিযুক্ত হতেন না বললেই চলে (সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ছিল না)।
পাকিস্থান নামক রাষ্ট্রের আবির্ভাব হলে শুরু হয় নতুন মাত্রার বৈষম্য। ভাষিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক, রাজনৈতিক, সামরিক থেকে শুরু করে হেন কোন সেক্টর নেই, যে সেক্টরে বাঙ্গালীদেরকে বৈষম্যের শিকার হতে হয় নি। আর এই বৈষম্যের সবচেয়ে দৃষ্টিকটু প্রকাশ ঘটতো উন্নয়ন বাজেট ও সরকারি চাকরিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্যে। বাঙালিদের মেধা থাকা সত্ত্বেও সরকারি চাকরিতে অধিকাংশ নিয়োগ দেয়া হতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পাবলিক সার্ভিস নামক রাষ্ট্রীয় সেবা সহজলভ্য করতে তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী কোলাবরেটরদের অপপ্রচার, সর্বহারা নামে প্রতিবিপ্লবী সংগঠনের অপতৎপরতা, কিসিঞ্জারের নির্দেশে খাদ্য বোঝাই জাহাজ ফিরিয়ে নেয়া এ রকম নানা ধরণের চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি এক শ্রেণীর অসৎ ও পাকিস্থানী মনোভাবাপন্ন আমলাদের অসহযোগিতার ফলে বঙ্গবন্ধুর চলার পথ হয়ে ওঠে সমস্যাসংকুল। এসব বিষয় উপলব্দি করে এবং পাকিস্থানী ব্লু-ব্লাডেড প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তনের অপরিহার্যতা বোধে বঙ্গবন্ধু ৪ নভেম্বর ১৯৭২ সালে গণপরিষদের ভাষণে একটি যুগান্তকারী অনুশাসন দিয়েছিলেন : "সরকারি কর্মচারীদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে যে তারা শাসক নন, সেবক। সরকারি কর্মচারীরা আলাদা কোন জাতি নয়। আইনের চোখে সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে অধিকার, সরকারি কর্মচারীদেরও সেই অধিকার"।
তাঁর এই অনুশাসনের প্রমাণ হলো সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের ২নং উপ-অনুচ্ছেদ। পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে ১৫ জানুয়ারি ১৯৭৫-এ প্রদত্ত ভাষণে সকলকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরেকটি যুগান্তকারী অনুশাসন দেন, ‘সমস্ত সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি,যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে,তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য,যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়,তার দিকে খেয়াল রাখুন। যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন।কিন্তু সাবধান,একটা নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয়।’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও স্পষ্ট অনুশাসন দিয়ে বলেন,‘এ জন্য আপনাদের কাছে আমার আবেদন রইলো,আমার অনুরোধ রইলো,আমার আদেশ রইলো।’
প্রশাসনযন্ত্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রক্রিয়ার আগেই ঘাতক দলের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে এবং সামরিক শক্তির অতিমাত্রার প্রভাব বলয়ের ফলে পরবর্তীতে পাবলিক সার্ভিস বিকাশ লাভে ব্যর্থ হয়। সময়ের হাত ধরে ২০০৯ সালে রাষ্ট্রের বর্তমান নির্বাহী অঙ্গ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে অধিকতর মনোযোগী হলে পাবলিক সার্ভিস বা নাগরিক সেবা প্রদান প্রক্রিয়া ক্রমান্বয়ে সহজতর হতে শুরু করে এবং আমার বিশ্বাস সামনের দিনগুলোতে তা আরো অনন্য উচ্চতা পাবে। কারণ, সরকারের Priority Agenda হলো Digital Bangladesh বাস্তবায়ন আর সর্বক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সময়োপযোগী ব্যবহার। এখন জনগণ আর শোষণের অনুষঙ্গ নয় বরং রাষ্ট্র জনগণকে সেবা গ্রহীতা হিসেবে ভাবছে। সরকারি কর্মচারীরা আর প্রভু নয় বরং সেবক হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলছে। আর এই ব্যাপকতর মানসিক পরিবর্তনে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে Digital Bangladesh নামক কর্মযজ্ঞ।
বর্তমানে ২৮টি ক্যাডার রয়েছে। কোনো কোনো ক্যাডার দৃশ্যমান আবার কোনো কোনো ক্যাডার অদৃশ্য থেকে জনগণকে সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। সেদিন একটি পরিসংখ্যান পড়ছিলাম- সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রশাসনযন্ত্রের অবদান মাত্র ৩% । কিসের ভিত্তিতে এবং কোন পদ্ধতিতে তা হিসেব করা হলো সেটা অবশ্য জানা যায় নি এবং আমার বেধগম্য নয়। আমার মনে প্রশ্ন থেকেই গেল??? আমাদের সবাইকে দৃষ্টি রাখতে হবে এবং বুঝতে হবে- সরকার বলতে আমরা কি বুঝি বা সরকার কে? সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্রের সব জনগণই সরকার।
As a Executive Part, রাজনৈতিক দল নির্দেশনা প্রদান করে ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা তা বাস্তবায়ন করে থাকে এবং জনগণ সে সব কর্মযজ্ঞের সুফল ভোগ করে। পাশাপাশি Legislature ও Judiciary জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্র তথা জনকল্যাণে নিয়োজিত থেকে সর্বক্ষেত্রে সুষম পরিবেশ বজায়ে সহযোগিতা করে থাকে। তাহলে সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সরকারী কর্মচারীদের অবদান কি অনেক বেশী নয়?
দৃশ্যমান পর্যায়ে যারা কাজ করে থাকে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো Police Service. অনেক সমালোচনা হয়তো রয়েছে কিন্তু একবার ভাবুন তো- পুলিশ বিহীন একদিনের বাংলাদেশ !
আমি জানি, ভাবতে পারবেন না। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেই আমাদের পুলিশ সার্ভিসের কর্মকর্তারা কাজ করেন, সেবা দেন। তেমনিভাবে Administration, Taxation, Customs, Family Planning থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে কর্মরত কর্মচারীরা এখন আর গতানুগতিক পর্যায় বা মানসিকতা নিয়ে কাজ করছে না। ৯-৫টা অফিস এখন আর নেই বললেই চলে! বিশ্বাস না হলে ICT Division এ চলে আসুন। প্রতিনিয়ত কিভাবে উন্নত Public Service দেয়া যায়, সে বিষয়ে এখন সবাই ওয়াকিবহাল ও সচেষ্ট।
নতুন বাংলাদেশে বিশ্বমানের Public Service প্রদান বা পাওয়া হয়তো খুব বেশী দূরে নয়। সময়ের বিবর্তনে Public Service Delivery উন্নত থেকে উন্নততর হবে, সে প্রত্যাশায় সবাইকে INTERNATIONAL PUBLIC SERVICE DAY-2016'র শুভেচ্ছা। [বি. দ্র.: সরকারী কর্মচারীদের রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতা নিষিদ্ধ। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কথা বলা রাজনীতি সংশ্লিষ্টতা নয়। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে হয়তো আজ সরকারি কর্মচারী হিসেবে আমি নিয়োগও পেতাম না। তাই, জাতির পিতার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ও অসীম শ্রদ্ধা রইলো।
লেখক : মো. আবু নাছের, পাবলিক রিলেশন অফিসার, আইসিটি মন্ত্রণালয়
বিবার্তা/মৌসুমী