জঙ্গি দমনে রাষ্ট্রের কৌশল ও নাগরিকদের দায়িত্ব

জঙ্গি দমনে রাষ্ট্রের কৌশল ও নাগরিকদের দায়িত্ব
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০১৬, ০০:৫২:৪৩
জঙ্গি দমনে রাষ্ট্রের কৌশল ও নাগরিকদের দায়িত্ব
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+
জঙ্গিবাদ এখন আর কোন দেশীয় কিংবা আঞ্চলিক সমস্যা নয়; এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটিও কারও অজানা নয় বিংশ শতাব্দীর ৯০-এর দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীকে হটিয়ে নিজেদের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সাম্রাজ্যবাদী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে আল-কায়দা ও তালেবান জঙ্গিদের অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ফ্রাংকেন্সটাইনের দানবে পরিনত করেছে। এই দানব এখন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশ, নাগরিক ও ভূখণ্ডকে গিলে খেতে চায়। এই হিংস্র মানবাতাবিরোধী দানবীয় গোষ্ঠী শান্তির ধর্ম ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা ও অপব্যবহার করে ইসলাম ও মুসলমানদের কলঙ্কিত করছে। আজ সারা পৃথিবীতে মুসলমানদের সন্দেহের চোখে দেখা হয় বিশেষ করে পাশ্চাত্য দুনিয়ায়। 
 
এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র ‘ওয়ার অন টেরর’ –এর নামে সমগ্র দুনিয়ায় সন্ত্রাসের এক রাম রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। সন্ত্রাস দমনের নামে অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব লংগন ও নাগরিক হত্যাকে দেশটি তার অধিকার ও দায়িত্ব বলে মনে করে। পৃথিবীর অনেক মানুষ ও বিশ্লেষক এটি বিশ্বাস করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ ও আধিপত্য ধরে রাখার জন্য মার্কিন তাত্ত্বিক স্যামুয়েল ফিলিপ হানটিংটনের ‘ক্লেশ অব সিভিলাইজেশন বা সভ্যতার দ্ধন্দ্ব’ তত্ত্বের আলোকে সারা দুনিয়ায় কখনো সন্ত্রাস লালন কিংবা কখনো সন্ত্রাস দমনের পৃথিবীকে সন্ত্রাসের এক উর্বর ভূমিতে পরিণত করেছে। আর সে জন্যই পৃথিবীর শান্তিপ্রিয় মানুষ কখনো তালেবান, কখনো আল-কায়দা, আবার কখনো বা আইএসের ভয়াবহতার সম্মুখীন হচ্ছে। যার সহজ টার্গেট সব ধর্মের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ ও মুসলমানরা। 
 
বাংলাদেশের অনেক তরুণ বিংশ শতাব্দীর ৯০-এর দশকে আফগানিস্তানে তালেবানদের সমর্থনে যুদ্ধ করেছিলেন। তারপর আফগান ফেরত সেই সব জঙ্গিরা স্লোগান দিয়েছিল ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। এরপর ২০০১ সালে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ তথা হুজির আত্মপ্রকাশ ঘটে। তারপর শায়খ আব্দুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম তথা বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) আত্মপ্রকাশ করে। এর ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হতে থাকে। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক রাজিব হায়দারকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে দেশে জঙ্গিরা প্রথম টার্গেট কিলিং শুরু করে। তারপর জঙ্গিরা বেছে বেছে এক এক করে লেখক অভিজিৎ রায়, প্রকাশক দীপন, ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, পীর, আলেম, পুরোহিত ও বিদেশী নাগরিকদের হত্যা শুরু করে। এসব হত্যাকাণ্ডে দেশে-বিদেশে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় উঠে। কিন্তু চলতি মাসের ১ জুলাই রাজধানী ঢাকার কূটনৈতিক পাড়া গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে ৬-৭ জন তরুণের জঙ্গিদল রেস্টুরেন্টটিতে খেতে যাওয়া সকলকে জিম্মি করে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। এদের ছোড়া গ্রেনেডের আঘাতে প্রথম নিহত হন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সালাউদ্দিন খান ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল ইসলাম। এছাড়া ৪০-৫০ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। সেনা-নৌ-বিমান বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনী সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে জিম্মি উদ্ধারে অপারেশন থান্ডার বোল্টে অভিযান পরিচালনা করে ১৩ জনকে জীবিত এবং ২৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এরমধ্যে ছয়টি লাশ সন্ত্রাসীদের বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হয়।নিহত সন্দেহভাজন হামলাকারীদের মধ্যে ইতোমধ্যে ৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন, খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েলের বাড়ি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার ব্রিকুষ্টিয়া গ্রামে। তিনি ডিহিগ্রাম ডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসা থেকে ২০১৫ সালে আলিম (এইচএসসি সমমান) পাস করে ফাজিল শ্রেণিতে ভর্তি হন। রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মীর সামেহ মোবাশ্বের স্কলাসটিকা থেকে ও লেভেল পাস করা, নিব্রাস ইসলাম মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বলের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলার ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের কৈয়াগাড়ি গ্রামে।
 
সেদিন রাতে এ জঙ্গিরা মহান আল্লাহ্‌র পবিত্র নামের স্লোগান “আল্লাহু আকবার” ধ্বনি দিয়ে অমুসলিমদের উপর আক্রোশ নিয়ে রক্তস্রোত বইয়ে দেয়। অথচ অমুসলিমদের নিরাপত্তায় রাসূলুল্লাহ (সা: ) বলেছেন, “মনে রেখো যদি কোন মুসলমান কোন অমুসলিমের উপর নিপীড়ন চালায়, তাদের অধিকার খর্ব করে, তার কোন বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়, তাহলে কেয়ামতের দিন আমি আল্লাহ্‌র আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিমের পক্ষাবলম্বন করবো।” [ আবু দাউদ] অন্য একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা: ) আরও বলেছেন,  “যদি কোন ব্যক্তি মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিক বা মুসলিম দেশে অবস্থানকারী অমুসলিম দেশের অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে তবে সে জান্নাতের সুগন্ধও লাভ করতে পারবে না, যদিও জান্নাতের সুগন্ধ ৪০ বৎসরের দূরত্ব থেকে লাভ করা যায়।” [ সহীহ আল-বুখারী, হাদিস]  পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে মহান আল্লাহ্‌ পাক বলেন, “ তোমাদের কাছে কোন প্রতিমা পূজারী মুশরিকও যদি ( বিপদে পড়ে) আশ্রয় চায়, তাকে আশ্রয় দিও, যেন সে আল্লাহ্‌র কালাম শুনতে পায়। অতপর (সে আল্লাহ্‌র কালামকে অস্বীকার করলেও) তাকে তার ( বিপদ কেটে যাওয়ার পর) নিরাপদ স্থানে পৌছে দিও। এটি এ জন্যে যে এরা জ্ঞান রাখে না।”[সূরা তওবা: ৬]
        
জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত জিরো টলারেন্স নীতি দক্ষিণ এশিয়াসহ সমগ্র বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে। তারপরও গুলশান জিম্মি খুন, টার্গেট কিলিং ও সর্বশেষ ঈদের দিন ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়ার ঈদ জামাতের পাশেই পুলিশের চেকপোস্টে আত্মঘাতী হামলায় দুই পুলিশ সদস্য ও দুই আত্মঘাতী জঙ্গিসহ পাঁচ জন নিহত হয়। এমন পরিস্থিতিতে জঙ্গি দমনে রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জননিরাপত্তা ও জঙ্গি দমনে নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে। তাছাড়া এই উগ্রবাদীদের নির্মূলে রাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি অভিভাবক ও দেশের সকল নাগরিকদের যার যার জায়গায় দায়িত্ব পালন করার আছে তা এখন সকলে উপলব্ধি করছেন। 
 
গুলশানে সংগঠিত জিম্মি হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এই বোধের সৃষ্টি করেছে যে উগ্রবাদী জঙ্গিদের ভয়াল থাবা থেকে এখন আর কেউই নিরাপদ নয়। ইতোপূর্বে কথিত নাস্তিক, লেখক, প্রকাশক, ব্লগার , পীর, আলেম, পুরোহিত ও বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডে সাধারণ জনগণ হয় নীরবতা পালন করেছে, অথবা এড়িয়ে গেছে, নয়তবা গোপনে উল্লসিত হয়েছে। কিন্তু গুলশান হত্যাকাণ্ড সবার বিবেক ও বোধকে নাড়িয়ে দিয়েছে যেখানে দেশি-বিদেশি, মুসলিম-অমুসলিম কেউই জঙ্গিদের জিগাংসা থেকে রেহাই পায়নি। এ ঘৃণ্য হত্যাযজ্ঞে প্রায় পুরো দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ ও ঘৃণা প্রকাশ করেছে। বিশেষত তরুণ প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করে। গুলশানে নিহত ৫ জঙ্গি বেশ অভিজাত পরিবারের সন্তান বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে। দেশের প্রচলিত ধারণা হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। কিন্তু এই উচ্চশিক্ষিত, আধুনিক ও ধনী পরিবারের সন্তানরা জঙ্গিবাদের সাথে জড়িয়ে পড়ায় জঙ্গিবাদ সম্পর্কে প্রথাগত ধারণা উলট পালট হয়ে যায়। এ ঘটনার পর দেশের অধিকাংশ মানুষ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও কিছু মানুষ এখনো জঙ্গিবাদকে মনে প্রানে লালন এবং আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক আস্কারা দিয়ে যাচ্ছেন। 
            
পৃথিবীর যেকোন দেশে যখনই জাতীয় দুর্যোগের সম্মুখীন হয় তখন সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে সে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। অথচ বাংলাদেশের মানুষ যখন গুলশানের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে উদ্বিগ্ন তখন দেশের সাবেক বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রথমে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দাবি করলেন। যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতি ইসলামীকে সাথে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়ায় অনেকেই এর আন্তরিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। 
সাম্প্রতিক সময়ের গুপ্ত খুন ও রাজধানীর গুলশানে জিম্মি করে মানুষ খুনসহ একের পর এক ঘটে চলছে দেশ, মানবতা ও ধর্মবিরোধী অপকর্ম। এই উন্মাদ খুনিরা তাদের আদর্শে ১০০ ভাগ কমিটেড। অথচ আমাদের আদর্শে কতভাগ কমিটেড আমরা যেটা আমরা প্রতিনিয়ত বুলি হিসেবে আওড়াই। এই ষড়যন্ত্রের পালক একের পর এক ভারী হচ্ছে - কারও ক্ষমতার হিসেব, কারও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর হিসেব, কারও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক হিসেব। এই দানবীয় কাজ রুখতে শুধু সরকার নয় সবার ঐক্য বড্ড বেশী প্রয়োজন। 
লেখক : মোহাম্মদ ইমাম হোসেন, ফ্যাকাল্টি মেম্বার, অর্থনীতি বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। 
 
বিবার্তা/ মৌসুমী/ ইফতি
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com