উদীচী থেকে শোলাকিয়া: বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ২৫ বছর

উদীচী থেকে শোলাকিয়া: বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ২৫ বছর
প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০১৬, ১০:১৪:২১
উদীচী থেকে শোলাকিয়া: বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ২৫ বছর
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’- স্লোগানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মৌলবাদী সংগঠনের গোড়াপত্তন হয় ১৯৯২ সালে। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে (১৯৭৯-৮৯) বেশ কিছু মুজাহিদ আফগানদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। তালেবানদের বিজয়ে উদ্বুদ্ধ আফগান ফেরত এ সকল ম্যাকবেথরা ৩০ এপ্রিল  জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ‘হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশ’ (হুজি) নামে একটি দল তৈরির ঘোষণা দিয়েছিল। এর দুইবছর পর টাঙ্গাইলের করতিয়া গ্রামে বায়েজাদ খান পন্নি ওরফে সেলিম পন্নির নেতৃত্বে ‘কোমরে হাতুরী’ সংগঠন ‘হিজবুত তাওহীদ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।

১৯৯৮ সালে হুজি থেকে বেরিয়ে এসে শায়েখ আব্দুল রহমান জামালপুরে ‘জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ’ (জেএমবি) গঠন করেন। ওই বছরই (বা মতান্তরে ২০০৩ সালের মাঝামাঝিতে) শায়খ রহমানের পরামর্শে সিদ্দিকুল ইসলাম ‘বাংলা ভাই’র নেতৃত্বে জেএমবির আরেকটি অংশ ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ’ (জেএমজিবি) গঠন করে। পরের বছর কাওসার হুসাইন সিদ্দিকী নামে একজন গড়ে তোলেন আরেকটি জঙ্গি সংগঠন ‘শাহাদাত-ই আল হিকমা’। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের অংশ হিসেবে ২০০১ সালে ‘হিযবুত তাহরীর’ ও ২০০৭-০৮ সালে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ (এবিটি) বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করে।

বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার সূচনা হয় ১৯৯৯ সালে। কবি শামসুর রাহমানের ওপর প্রথম এ হামলাটি করেছিল হুজি। তবে মার্চে বড় আকারে প্রথম বোমা হামলা হয় যশোরের উদীচী সমাবেশে। ওই হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১৫০ জনের বেশি আহত হয়েছিল। উদীচীর রেশ কাটতে না কাটতে খুলনা শহরে আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলায় আটজন নিহত হয়। ২০০১ সালের শুরুতেই রাজধানীর পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলা হয়েছিল। এতে ঘটনাস্থলেই চারজন এবং পরে একজন হাসপাতালে মারা যান। তিন মাস না পেরুতেই রমনার বটমূলে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমাহামলায় ১০ জন নিহত হয়েছিল। ওই বছরের জুনে গোপালগঞ্জের বানিয়াচং গীর্জায় প্রার্থনা চলাকালে বোমা হামলায় ১০ জন নিহত, আহত অর্ধশত এবং সেপ্টেম্বরে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে বাগেরহাটের মোল্লাহাটে খলিলুর রহমান ডিগ্রি কলেজ মাঠে এক নির্বাচনী জনসভায় রিমোট কন্ট্রোল নিয়ন্ত্রিত শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে আটজন নিহত, ৫০ জন আহত হয়। ধারণা করা হয়, সবগুলো হামলাতেই হুজি সদস্যরা জড়িত ছিল।   

এরপর বছর খানেকের বিরতি। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে আরেক নির্বাচনী আলোচনা সভায় বোমা বিস্ফোরণে চারজন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। এর মাত্র দুইদিন পর সাতক্ষীরা শহরের একটি সিনেমা হল ও স্টেডিয়ামে সার্কাসের প্যান্ডেলে বোমা হামলায় তিনজন নিহত ও আহত হয় অন্তত ১৫০। বিজয়ের মাসের শুরুতে কামানের তোপের মতো আবারো গর্জে ওঠে বোমা। ময়মনসিংহ শহরের চারটি সিনেমা হলে (অজন্তা, ছায়াবাণী, অলকা ও পূরবী) দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে পরপর কয়েকটি বোমা হামলায় শিশু ও নারীসহ ১৮ জন নিহত ও দর্শকসহ আহত হয় দেড় শতাধিক মানুষ।  এ হামলায় জঙ্গিবাদের লাইমলাইটে আসে জেমএমবি।  

২০০৩ সালে সবচেয়ে বড় বোমা হামলা হয় জানুয়ারিতে। টাঙ্গাইলের সখীপুরের দড়িয়াপুর গ্রামের ফালুচাঁন পাগলার মাজারে রাতে বোমা বিস্ফোরণে সাত জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। এছাড়া বিচ্ছিন্ন কয়েকটি স্থানে বোমা হামলার মধ্যে রয়েছে খুলনায় বাণিজ্য মেলায় কর্তব্যরত পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে অবস্থিত রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশে বোমা বিস্ফোরণ, খুলনায় অ্যাডভোকেট মঞ্জুর ইমামের ওপর বোমা নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ এবং খুলনা বাস টার্মিনালে একটি পরিবহনে বোমা হামলা। এ সকল হামলায় মোট চার জন নিহত হয়।  

মার্কিনী হামলায় ২০০১ সালে আফগানিস্থান ও ২০০৩ সালে ইরাকের পতনের পর সন্ত্রাসবাদের আন্তর্জাতিকীকরণের ‘স্পিলওভার ইফেক্টে’ বাংলাদেশেও জঙ্গিবাদ ভয়াবহভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দেশে জঙ্গি হামলার ইতিহাসে প্রথম ভয়াবহ সময় ২০০৪-০৫ সাল। বোমা ও গ্রনেড হামলার কারণে শুধু ২০০৪ সালেই শতাধিক লোক প্রাণ হারায়। ২০০৪ সালটা শুরু হয় জানুয়ারিতে হযরত শাহজালাল (র.) মাজার প্রাঙ্গণে প্রথম দফা বোমা হামলা দিয়ে। এ হামলায় প্রাণ হারায় সাতজন। এখানে দ্বিতীয়বার গ্রেনেড হামলা হয় ২১ মে। দুইজন প্রাণঘাতী হুজির এ হামলায় ব্রিটিশ হাইকমিশনারের হাইকমিশনারসহ আহত হয় ৭০ জন। জানুয়ারিতে নিহত হন সাংবাদিক মানিক সাহা, ফেব্রুয়ারিতে হামলা হয় হুমায়ুন আজাদের উপর, জুনের হামলায় মারা যান সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু, জুলাইয়ে জামালপুরের মাদারগঞ্জে বোমা হামলায় ছয়জন রাজনৈতিক কর্মী নিহত হয়, আগস্টে সিলেটে গুলশান হোটেলে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণে একজন নিহত ও ৪০ আহত হয় এবং ডিসেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইউনুস আলীকে হত্যা করা হয়।

২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে রাজশাহীর বাগমারার ও নওগাঁর আত্রাই-রানীনগর এলাকায় সর্বহারা দমনের নামে সিনেম্যাটিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে ‘বাংলা ভাই’র জেএমবি। বাগমারার গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের পলাশী গ্রামে মোনায়েম হোসেন বাবুকে হত্যাতর মধ্য দিয়ে ‘বাংলা ভাই’র তাণ্ডবলীলা শুরু হয়। আট-নয় মাসের মধ্যে তিনি ২৪ জনকে হত্যা করেন এবং তিন শতাধিক লোকের ওপর বর্বর নির্যাতন চালান। প্রথমদিকে নায়কোচিত মিডিয়া কাভারেজ ও মদদ পেলেও ধীরে ধীরে তার মুখোশ জনগণের কাছে উম্মোচিত হয়ে যায়।  

ওই বছরের সবচেয়ে বর্বোরোচিত হামলা ২১ আগস্ট পরিকল্পিতভাবে সংঘবদ্ধ জঙ্গি গ্রুপের বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সমাবেশে গ্রেনেড হামলা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ওই হামলায় ২৪ জন নিহত হয়, আহত হয় অন্তত আরও ৪০০ থেকে ৫০০ জন।

বাংলাদেশের যাত্রা-সংস্কৃতির জন্য এক দুঃসময়ের বছরও এটি। পরপর তিনমাসে তিনটি যাত্রা প্রদর্শনীতে বোমা বিস্ফোরণে তিনজন নিহত ও ২৬ জন আহত হয়। নভেম্বরে মৌলভীবাজার, ডিসেম্বরে গাইবান্ধা ও জানুয়ারিতে বগুড়ায় হয়েছিল এ তিনটি হামলা। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সিনেমা হলে, যাত্রামঞ্চে জেএমবির এসব হামলায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।  

২০০৫ সালে বোমা হামলায় নতুন আরেক মাত্রা যোগ হয়, আদালত-এজলাশ ও এনজিওতে বোমা হামলা। লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ঝালকাঠি, গাজিপুরের বিভিন্ন আদালতে হামলায় বিচারক সোহেল আহমেদ চৌধুরী, বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও কয়েকজন আইনজীবীসহ নিহত হয় ১৮ জন। এছাড়া আহত হয় ৯০ জনেরও বেশি। ওই বছরে দুইবার ‘ব্রাক’ এনজিওটিতে হামলা হয়। গোপালগঞ্জ ও নওগাঁর এ হামলায় আহত হয়ছিল অর্ধশতাধিক।

ওই বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ১৭ আগস্টের সিরিজ বোমা হামলা। সেদিনে জেএমবি ৬৩টি জেলার ৫১১টি স্থানে একযোগে বোমা হামলা চালায়। এ হামলায় তিনজন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়। অন্যান্য বোমা হামলার মধ্যে রয়েছে হবিগঞ্জে সাবেক অর্থমন্ত্রীকে বোমা মেরে হত্যা (নিহত ৫, আহত ৫০),  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোবাসা দিবসের অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণ (আহত ৮), গাজীপুর ডিসি অফিসে বোমা হামলা (নিহত ১, আহত ৪৮) এবং নেত্রকোনায় উদীচী ও শত দল শিল্পগোষ্ঠীর অফিসে বোমা হামলা (নিহত ৮, আহত ১০০)।

দেশে জঙ্গি হামলা শুরুর ষষ্ঠবছরের পর থেকে আমাদের শম্ভুক বোধোদয় হতে থাকে। জঙ্গিবাদ দমন ও জঙ্গিদেরকে ধর-পাকড়ে তৎপরতাও বৃদ্ধি পায়। অদ্যাবধি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধঘোষিত এসব জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে শাহাদাত-ই আল হিকমা, হুজি, জেএমজেবি, জেএমবি, হিযবুত তাহরীর ও এবিটি অন্যতম।

২০০৬ সালে সিলেটের টিলাগড় এলাকা থেকে হলিউডের কায়দায় শায়খ রহমান (২ মার্চ), ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় (৬ মার্চ) ‘বাংলা ভাই’ এবং ১৯ মার্চ ডেমরা থেকে খালেদ সাইফুল্লাহ গ্রেপ্তার হয়। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ দিবাগত রাতে শায়খ রহমান ও ‘বাংলা ভাই’কে ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ২০০৭ সালে জেএমবি কর্তৃক ঝালকাঠি পাবলিক প্রোসিকিউটর হায়দার হোসেনকে গুলি করে হত্যা এবং এর দুই বছর পর গাজীপুরের পুলিশ সুপারের সম্মেলনে গ্রেনেড হামলা ছাড়া দীর্ঘদিন বড় ধরনের জঙ্গি নাশকতা দেখা যায়নি। তাই মানুষের মন থেকে জঙ্গিবাদ, বোমাতঙ্কও ধীরে ধীরে মুছতে থাকে।  

পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন ‘তেহরিক-ই আজাদি’র অস্ত্র-বোমা তৈরিতে প্রশিক্ষিত শেখ রহমত উল্লাহ মাসুম ২০১২ সালে জেএমবিকে আবার সংগঠিত করে। কথিত আছে, ওই বছর সেনা বাহিনীতে ক্যু করার চেষ্টা করে হিজবুত তাহরীর।

১৯৯৯ সাল থেকে বিভিন্ন নামে জঙ্গি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্যা লেভান্ট’ (আইএসআইএল বা দায়েশ) নামে আত্মপ্রকাশ করে ২০১৩ সালে। প্রথমদিকে ইরাক, সিরিয়া ও লেভান্ট অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের ইচ্ছা থাকলেও পরবর্তীতে সালাফিবাদে বিশ্বাসী এ সংগঠন বিশ্বব্যাপী ইসলামী ‘খেলাফাত’ প্রতিষ্ঠার নেশায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রক্তের হোলিখেলা শুরু করে। পরের বছর এরা নিজেদেরকে ‘ইসলামিক স্টেট’ (আইএস) পরিচয় দিতে শুরু করে।  

বাংলাদেশে ২০১৩ সালে এবিটি, জেএমবি, হুজিদের হত্যা মিশনে নতুন সংযোজন হলো নাস্তিকতার ব্যাখ্যায় ‘টার্গেট কিলিং’। একের পর এক তাদের হামলার শিকার হয় আসিফ মহিউদ্দীন, রাজিব হায়দার, জগতজ্যোতী তালুকদার, সানাউল রহমান, আরিফ রায়হান দ্বীপ, উম্মুল মোমিনিন তৈয়ুবুর রহমান ও তার ছেলে, তন্ময় আহমেদ, জাকারিয়া বাবু ও পীর লুতফর রহমানসহ ছয়জন। এ ধরণের হামলা ২০১৪ সালেও চলতে থাকে। ওই বছর হামলার শিকার রাহয়ান রাহি, উল্লাহ দাস, রাকিব, টিভি উপস্থাপক শেখ নুরুল ইসলাম ফারুকী, আশরাফুল ইসলাম এবং সর্বশেষ রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক একেএম শফিউল ইসলাম।  

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ‘টার্গেট কিলিং’ হয় ২০১৫ সালে। একে একে হামলার শিকার হয় চট্টগ্রামে নার্সিং প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা অঞ্জনা দেবী, ‘মুক্তমনা’র প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিত রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় দাস, নীলয় নীল, শিক্ষক মানব চন্দ্র রায়, ইতালির নাগরিক তাবেলা, জাপানি নাগরিক হোসি কুনিও, আধ্যাত্ত্বিক নেতা খিজির খান,  জাগৃতি প্রকাশক আরেফিন ফয়সাল দীপন, শুদ্ধস্বরের প্রকশক টুটুল, বাহাই সেন্টার ডিরেক্টর রুহুল আমিন এবং ইসকনের প্রেসিডেন্ট বীরেন্দ্র নাথ। আগের বছরের মতো এবারও হত্যার অস্ত্র হিসেবে ‘চাপাতি’ বহাল থাকলো। তবে আরেক নতুন সংযোজন হলো অন্যান্যদের পাশাপাশি এ বছরের বেশ কয়েকটি হত্যার ‘দায় স্বীকার’ করে আইএস।  

ওই বছর বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিয়া ও দ্বিতীয়বারের মতো আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়। অক্টোবরে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে গ্রেনেড হামলায় নিহত এক, আহত অর্ধশতাধিক। পরের মাসে বগুড়ায় শিয়া মসজিদে ঢুকে গুলি চালানো হলে মুয়াজ্জিন নিহত হয়। ডিসেম্বরে রাজশাহীর বাগমারায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে জুমার নামাজের সময় আত্মঘাতী বোমা হামলায় একজন নিহত ও দশ জন আহত হয়। একই মাসে দিনাজপুরে রাসমেলার যাত্রা প্যান্ডেলেও বোমা বিস্ফোরণে দশ জনেরও বেশি আহত হয়। সবগুলো হামলাতেই আইএস ও জেএমবি উভয়েই ‘দায় স্বীকার’ করে।

২০১৬ সালের শুরু থেকে একে একে যারা জঙ্গিবাদের শিকার হয় তারা হলেন পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জে হিন্দু পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর রায়, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদ, ঝিনাইদাহে শিয়া ধর্ম প্রচারখ আব্দুল রাজ্জাক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী, ‘রূপবান’ পত্রিকার সম্পাদক জুলহাজ মান্নান,  নাট্য ও সমকামীদের অধিকার আন্দোলনের কর্মী মাহবুব তন্ময়, নিখিল চন্দ্র জোয়ারদার, রাজশাহীর তানোর উপজেলার ‘পীর সাহেব’ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বান্দরবানের বাইশারী ইউনিয়নের চাক পাড়ার বৌদ্ধ ভিক্ষু মংশৈ উ চাক, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের জুতা ব্যবসায়ী দেবেশ চন্দ্র প্রামাণিক, নাটোরে খ্রিস্টান ব্যবসায়ী সুনীল গমেজ, ঝিনাইদহে বৃদ্ধ পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলি, পাবনা সদর উপজেলার হেমায়েতপুরে শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সৎসঙ্গ সেবাশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পান্ডে, ঝিনাইদহে হিন্দু সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস ও বান্দরবানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মংশৈনু মারমা। এসকল হত্যাকাণ্ডের কয়েকটিতে আনসার-আল-ইসলাম নাম এলেও অধিকাংশ হত্যার জন্য আইএস ‘দায় স্বীকার’ করে।  

উদীচী, রমনা, ২১ আগস্টের সংঘবদ্ধ জঙ্গি হামলা, ১৭ আগস্টের সিরিজ বোমা হামলার পর বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ঘটনার নাম গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলা। দেশে চোরাগোপ্তা, আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার ইতিহাস থাকলেও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের স্টাইলে জিম্মিকরণের মাধ্যমে এমন হত্যার ঘটনা এটাই প্রথম। এই জিম্মি ঘটনায় ১৭ বিদেশীসহ (৯ জন ইতালিয়, ৭ জন জাপানি, একজন ভারতীয়) ২০ জন, ছয় সন্ত্রাসী ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২৮ জন নিহত হয়। এছাড়া ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।

পুরো জাতিকে ট্রমাটাইজড করা এ হামলার রেশ কাটতে না কাটতে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাতের মাঠের কাছে বিস্ফোরণ ও গুলির ঘটনা ঘটে। এতে দুই পুলিশসহ নিহতের সংখ্যা চারজন। আহত হয় প্রায় ১২ জন, যাদের বেশিরভাগই পুলিশ।

ইসলামী আইন, শরীয়াহ কায়েম ইত্যাদি জাতীয় বাহুল্য শব্দাবলীর দোহাই দিয়ে দেশে যে জঙ্গি হামলার সূত্রপাত হয়েছিল তা এখন যেমন সে অবস্থানে নেই, কোনোদিনও সেটা ছিল না- এ সত্যটুকু বুঝতে আমাদের প্রায় ২৫টি বছর পার হয়ে গেল। হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁ ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার পরেও কি আমরা বিশ্বাস করব না যে জঙ্গিবাদের কোনো ধর্ম কোনোদিন ছিল না, যেমন আজও নেই।

বিঃদ্রঃ- বিভিন্ন হামলায় নিহত, আহতের সংখ্যা বিভিন্ন পত্রিকা হতে সংগৃহীত। বিভিন্ন পত্রিকাতে এ সংখ্যার মধ্যে কিছুটা অমিল থাকার কারণে সংখ্যাগত সঠিকতা নিরূপণে জটিলতা থাকার অবকাশ রয়েছে।

লেখক: মো. আলাউদ্দিন ভুঁইয়া, কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি (রাজনৈতিক)

বিবার্তা/নিশি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com