ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষা ও রাজনীতি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষা ও রাজনীতি
প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০১৬, ১৬:২২:৩৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষা ও রাজনীতি
হুসাইন সাদ্দাম
প্রিন্ট অ-অ+
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড' বলা হয় কী কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই এর উত্তর জানে না। অনেকে আবছা আবছা ভাবে মনে করেন সম্ভবত এর শিক্ষার গুণগত মানের জন্য। মূলতঃ অক্সফোর্ডের ন্যায় 'আবাসিক বৈশিষ্ট্যের' জন্য এরকম উপমার চল হয়, যাতে প্রচেষ্টা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো হবে সভ্যতার নির্মাতা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধূলা, সহ-পাঠ্য কার্যক্রমের সূতিকাগার। শিক্ষার্থীরা শুধু উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে তা নয়, তারা হয়ে উঠবে পূর্নাঙ্গ মানুষও। 
 
তবে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত অনেক খ্যাতিমান পণ্ডিত, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, ভাষাতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ, দার্শনিক, সমাজ-বিশ্লেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। শিক্ষার্থীরাও ছিল জ্ঞানের মৌলিকত্বে সম্ভাবনাময়। বিশ্বসভ্যতার পরিসরে নতুন জ্ঞানের সৃজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদচারণা অনেককেই আশার আলো দেখিয়েছিল সে সময়। ভারত বিভাগ বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতির দেহে অনেকগুলো ক্ষতই শুধু সৃষ্টি করেনি, এ দেশের সবেধন নীলমণি  'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে'ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটের মুখে ফেলে দেয়। ভীনদেশে পাড়ি জমান প্রথিতযশা পন্ডিত এবং অনেক সজীব-সবুজ প্রাণ। 
 
১৯৪৭ এর পরে এ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বিপ্লবের দাবানল। ভাষার দাবিতে, শিক্ষার অধিকারের দাবিতে, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষায়, সামরিক-স্বৈরশাসনের অবসানের দাবিতে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়, গণমানুষের মুক্তির আন্দোলনে, স্বায়ত্তশাসন-স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় দিকবিদিক নিশান উড়িয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। মশাল জ্বালিয়েছে প্রজন্মের ক্ষোভের, তারুণ্যের স্পর্ধার, মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্নের। বাংলাদেশের জন্ম হওয়াই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠতম অর্জন অনেক অর্জনের ভীড়ে ভীড়ে। স্বাধীনতার পরে এ বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে সুন্দর হয়ে উঠেছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের দিনগুলোতে। এরপরেও জলপাই রঙের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, শোষকের বিষদাঁত ভেঙ্গে রাজপথ মিছিল-স্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছে অনেকবার। তারুণ্যের দ্রোহ দেখেছে ২০০৭ সালে, তারুণ্যের জাগরণ উৎসব দেখেছে ২০১৩ সালে। 
 
মোটা দাগে এই হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনপঞ্জী। স্বাধীনতার পরে যে আকাঙ্খা নিয়ে এদেশের মানুষের এত সংগ্রাম, এত ত্যাগ তার বেশিরভাগই পদদলিত হয়েছে জান্তার বুটের তলায়। পরাজিত বিশ্বাসের ঝান্ডাধারীরা ক্ষমতার মসনদে বসেছে বারবার, ছড়ি ঘুরিয়েছে এদেশের মানুষের উপর। পচন ধরেছে তাই এখানেও। অনেক জঞ্জাল জমেছে যা আগে ছিল না কখনো, অনেক ব্যর্থতা দৃশ্যমান যা এতটা প্রকট ছিল না, হরেক রকম নিষ্ক্রিয়তা জেঁকে বসেছে নতুন করে, যা আগে ছিল প্রাণের উচ্ছ্বল-অনর্গল-অমিত প্রকাশ। 
 
এর ফলাফল হল- বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মূল কাজ মৌলিক জ্ঞানের প্রসার এবং শিক্ষার্থীদের প্রাগ্রসর জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা তা রীতিমত আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এজন্যই, ষোলো কোটি মানুষের দেশের প্রধানতম বিশ্ববিদ্যালয় র্যাং কিং কয়েক হাজারের মধ্যেও থাকে না। এমনকি দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিত্ব বলতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বোঝে বিসিএস-এ একচেটিয়া আধিপত্য, চাকরির বাজারে সুনাম বা নিদেনপক্ষে একটি ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাক্ষী গোপাল হওয়া ! উন্নত দেশগুলোতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের সর্বাধিক আগ্রহ থাকে মৌলিক গবেষণার বিষয়গুলোতে; তারপর কারিগরি, প্রযুক্তি কিংবা চিকিৎসাবিদ্যা। আমাদের দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের তৃতীয়-চতুর্থ পছন্দ। 
 
সার্বিকভাবে দেশীয় পরিসরে উচ্চশিক্ষা বিষয়ে মানুষের মধ্যে কিছু সামাজিক কুসংস্কার আছে, রাষ্ট্রের ভুল পরিকল্পনা বা পরিকল্পনাহীনতা আছে যার ফলে উচ্চশিক্ষারত শিক্ষার্থীরা জ্ঞানকেন্দ্রিক কর্মপ্রবাহের চেয়ে জীবনকে ভিন্ন কর্মতৎপরতায় নিয়োজিত রাখতে চায়; কিন্তু গুণগত মানের নিম্নমুখীনতার জন্য  বিশ্ববিদ্যালয়ও তার দাঁয় এড়াতে পারে না। কলা ও সামাজিক বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলোর শিক্ষাপ্রক্রিয়া,গবেষণা,জ্ঞান অন্বেষণ সৃজন আশাজাগানিয়া নয়। বাণিজ্য অনুষদের মনোযোগ যতটা কর্পোরেটকেন্দ্রিকতায়, রাষ্ট্রীয় ও গণমানুষের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি, স্থিতি-পরিবর্তন, সামষ্টিক-ব্যাক্তিক উন্নয়নের ভারসাম্যের উপযোগী জ্ঞান নির্মাণ-বিকাশে ততটা নয়।
 
সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের। সংস্কৃতি সভ্যতার প্রাণ, মানুষকে পূর্নাঙ্গতার রুপায়নে সবচেয়ে বড় প্রভাবক। সংস্কৃতি রাজনীতির চেয়েও শক্তিশালী, পরিবর্তনের পাথেয়, ইতিহাসের গতিধারায় রক্তসঞ্চালনকারী। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক পরিসর সীমাবদ্ধ দিবসওয়ারী প্রশাসনিক উদযাপন, টিএসসি ভিত্তিক সংগঠনগুলোর টুকরো টুকরো প্রচেষ্টার মধ্যেই। হলগুলো বিরানভূমি হয়ে রয়েছে এমনভাবে যেন মানুষের কোন সাংস্কৃতিক জীবন থাকতে নেই। বরাদ্দ অপ্রতুল, যেটুকু থাকে তার খবরও বা কে রাখে! কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা সংস্কৃতি সংসদ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিসরে কোন উদ্যোগ নেই। যে সব আছে সেগুলো ‘ভাড়াটে’ শিল্পীদের পরিবেশনা; শিক্ষার্থীদের আপন সৃজনীতে অংকুরিত  গান,  কবিতা,  নাটক কিংবা সৃজনশীল প্রকাশ সংখ্যায় নগণ্য। প্রভাতফেরী রুটিমমাফিক, আগের মতো চেতনার আলোয় উদ্ভাসিত নয়। রবীন্দ্র-নজরুল উৎসব, একুশকে ঘিরে লিটল ম্যাগাজিনের নব্বান্ন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন এখন একরকমের ‘সাংস্কৃতিক ডাইনোসর’। 
 
ছাত্র সংগঠনগুলোর ভূমিকা রাখার কথা ছিল; কিন্তু এখনকার ছাত্ররাজনীতির কর্মকৌশল এমন যেন ‘রাজনীতি’ ও ‘সংস্কৃতি’ ভিন্ন ভিন্ন দুটি প্রবাহ, কোনো ধরনের মিথষ্ক্রিয়া থাকতে নেই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণিরা শুধু সংস্কৃতি ‘উপভোগ’ করেই জীবনযাপন করতে পারে না, সংস্কৃতি বিনির্মাণের দায়িত্বও তাদের। আর সংস্কৃতি মানে শুধু গান-কবিতা-নাটক-নাচ নয়, সংস্কৃতি পুরো জীবনের অবয়ব। এখনকার তরুণদের সমাজদর্শন-জীবনবোধ-আত্ব-উপলব্ধি আশা-জাগানিয়া নয়।
 
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্জনগুলোর কারিগর এদেশের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। ডাকসু অচল ২৫ বছর ধরে। ডাকসুর অনুপস্থিতির কারণে সামগ্রিকভাবে ছাত্ররাজনীতি একধরনের বন্ধ্যাত্ব, ছাত্রস্বার্থবিমুখতা, পরোক্ষ বিরাজনীতি, অসংস্কৃত চর্চার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক যে মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের বিকশিত হওয়ার কথা, তা সম্পূর্ণরুপে অপাংক্তেয় বলে পরিগণিত হচ্ছে। জাতীয় রাজনীতিতে মেধাবী, সৃজনশীল, গণমুখী, তরুণ নেতৃত্বের যে শুণ্যতা এর বড় একটি কারণ ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া। ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য এরকম প্রস্তুতিহীন পরিস্থিতি জাতীয় রাজনীতিতে আরো ভয়াবহ রকমের স্থবিরতা সৃষ্টি করবে। শিক্ষার বিষয়গুলো মূলধারার ছাত্ররাজনীতিতে খুব একটা ‘ফ্যাক্টর’ না হওয়াতে ছাত্র আন্দোলন বা ছাত্ররাজনীতির মৌলিক যে দায়, প্রাথমিক যে অঙ্গীকার যে রাষ্ট্রের তরফ থেকে শিক্ষাকে সার্বজনীন, সহজলভ্য, আধুনিক, মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক, উৎপাদনমুখী করা, শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থায় জাতীয় স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটানো, এসব বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। 
 
নির্বাচিত ছাত্রনেতৃত্ব না থাকার সরাসরি যে ক্ষতি তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ছাত্রদের অংশীদারিত্ব না থাকা; এর ফলে প্রশাসন অনেকটা স্বৈরতান্ত্রিক ধারায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণ অপ্রতিহত হওয়ার পেছনে এটি অন্যতম নিয়ামক। শিক্ষার্থীরা কিভাবে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখতে চায় প্রশাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি এখন একটি ‘অপ্রাসঙ্গিক’ ও ‘বাতিল’ ইস্যু। সাধারণভাবে ছাত্র সংগঠনগুলো মূল রাজনৈতিক দলগুলোর অনুগামিতা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি, লক্ষ্য-কর্মসূচী নির্ধারণে শিক্ষা-শিক্ষার্থীকে ‘ভিত্তি’ ধরতে পারেনি, সাংস্কৃতিক কর্মপ্রবাহ নির্ধারণ করতে পারেনি। ছাত্ররাজনীতি তাই এখনও অবিকশিত, অপূর্নাঙ্গ, অনেকাংশে ম্লান; যার প্রভাব পড়েছে শিক্ষা ও ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিবেশের উপর।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রগতির যুদ্ধে পরাজয় হবে না জেনেই কৃষ্ণচূড়ার রঙে রাজপথ রাঙিয়েছে অজস্রবার। সাম্প্রদায়িক-পশ্চাৎমুখী রাজনীতিকে পরাজিত করেই ক্রমশ মুক্তির আঁতুরঘর হয়ে উঠেছে পবিত্র এ শিক্ষাঙ্গন। নেতৃত্ব দিয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই। সমাজ-প্রগতির ধারাতেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক মানস গড়ে তুলতে চেয়েছে সব সময়। অপ্রিয় গল্পও আছে। ১৯৭৭ সালে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়ে স্বাধীনতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধী-সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-সন্ত্রাসনির্ভর সংগঠন ‘ছাত্র শিবির’ পুনরায় এ বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রান্ত করার চেষ্টা করে। ১৯৭৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের ভাষ্কর্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদস্পন্দন ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভেঙে ফেলার জন্য সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয় অপরাধী এ সংগঠনটি। 
 
১৯৯০ সালে সব ছাত্র সংগঠনের সম্মিলিত প্রয়াসে ‘পরিবেশ পরিষদের’ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এ সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে প্রকাশ্যে কার্যক্রম না চালালেও পরোক্ষভাবে তারা তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাপর ছাত্র সংগঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে ঘিরে তাদের ছদ্মবেশী কর্মধারা পরিচালনার।
 
২০০০ সালে বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ‘হিযবুত তাহরির’ তাদের কার্যক্রম শুরু করে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে। সেমিনার-সিম্পোজিয়াম-আলোচনা সভার নামে চলতে থাকে সাংগঠনিক কার্যক্রম। বর্তমানেও গোপন কর্মতৎপরতার পাশাপাশি প্রকাশ্যেই চলছে তাদের প্রচারণা, পোস্টার, লিফলেট বিতরণ। এছাড়াও ক্রিয়াশীল রয়েছে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন নামের মৌলবাদী সংগঠনের গোপন কার্যক্রম। প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা, মূলধারার রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কাঠামোগত রাজনীতির অনুপস্থিতি, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের শক্তিহীনতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অবয়বের খরা প্রকারান্তরে মৌলবাদী রাজনীতিকে শক্তিশালীই করছে; ভবিষ্যতে যা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।  
 
এ বিশ্ববিদ্যালয় তার আবাসিক চরিত্র হারিয়েছে বহু আগেই যার জন্য প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে এ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অনন্য। প্রায় চল্লিশ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে আঠার হাজার শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে আবাসিক ব্যবস্থা। প্রকৃতার্থে আবাসিক হলগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এর ঢের বেশি। এর প্রভাব পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়রে সামগ্রিক ও হলগুলোর শিক্ষায়তনিক পরিবেশের উপর। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরের সড়কগুলো সম্পূর্ণ উন্মুক্ত থাকায় ‘মহাসড়কের’ সাথে এর পার্থক্য ধীরে ধীরে কমে আসছে, ক্রমশ রুগ্ন হয়ে উঠছে সবুজ-সজীব এ ক্যাম্পাস। শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার অপরিহার্য অনুষঙ্গ গ্রন্থাগারের দিকে তাকালেই উচ্চশিক্ষাকে বিশ্ববিদ্যালয় কিভাবে দেখছে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ১১০০ এবং বিজ্ঞান গ্রন্থাগারের ৪০০ আসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর গ্রন্থাগার সুবিধা নিশ্চিত করে, অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে যা হওয়া উচিত ছিল ২৫ শতাংশ। প্রাপ্ত যা সুবিধা রয়েছে তারও সঠিক ব্যবহার হয় না, অবহেলায় পড়ে থাকে গবেষণাধর্মী ক্ল্যাসিক গ্রন্থগুলি। টিপ্পনি কেটে অনেকেই তাই লাইব্রেরির নাম দিয়েছে ‘বিসিএস প্রিপারেশন সেন্টার’!  
 
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইউজিসির ২০ বছর(২০০২-২৬) মেয়াদী কৌশলপত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও অভ্যন্তরীণ খাত থেকে অর্থ আদায়ের নীতি নিতে বাধ্য করছে, যার প্রভাব পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে হরেক কিসিমের ফি চালু আর বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে। সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু উচ্চশিক্ষার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠছে। একটি আধুনিক-স্বনির্ভর-উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ে’ রুপান্তরের প্রয়াসের চেয়ে ‘স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণনির্ভর কর্মসূচী ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রশাসনের কাছে বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। বার্ষিক যে বাজেট প্রদান করা হয় তা নিতান্তই অপ্রতুল; এর সিংহভাগ ব্যয় করা হয় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে; অবকাঠামো সমস্যার সমাধান, আবাসন সংকট নিরসন, আধুনিক গবেষণা উপযোগী ল্যাব, উন্নত লাইব্রেরি, জার্নাল প্রকাশ- এসব অপরিহার্য বিষয় ধারাবাহিকভাবেই পরাকাষ্ঠার সাথে উপেক্ষিত। এর প্রভাবে জ্ঞান সৃজন, নবায়ন, নির্মাণের যে ঐতিহাসিক দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তা পালনে ব্যার্থ হচ্ছে উচ্চশিক্ষার এ প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। বিদেশী শিক্ষক-শিক্ষার্থীর শুণ্যতাই প্রমাণ করে এ বিশ্ববিদ্যালয় কতটা ‘বৈশ্বিক’, বিশ্বের কাছে এর শিক্ষাদানের গুরুত্ব কতটুকু, অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য আগ্রহোদ্দীপক কিছু নির্মাণ আমরা করতে পারছি কিনা!
 
আমাদের স্বপ্নগুলোকে তাড়া করার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয় অপ্রস্তুত। আমাদের সংকটগুলো সমাধানের জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয় অসক্ষম। আমাদের আত্বজিজ্ঞাসা করতে হবে, আমরা সামনের দিকে এগুবো না পশ্চাদপসরণ করব। দায় এড়ানোর জনপ্রিয় কিম্ভুতকিমাকার আত্বতৃপ্তি আমাদের অহংবোধ শক্ত করলেও সময়ের কাছে আমরা পরাজিত হব। প্রচলিত অচলতা, সময়ের ফ্যাশন মুখ ফিরিয়ে থাকা, ঢাবিতে পড়ার জমিদারি ভালো লাগা আমাদের সত্যিকারের বিজয় থেকে দূরেই ঠেলে দেবে কেবল। শিক্ষা-গবেষণা, সংস্কৃতি, ছাত্র রাজনীতির আধুনিক-মানবিক-প্রগতিশীল বিনির্মাণ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার বর্তমান নিয়ে ভবিষ্যতে গর্ববোধ করতে পারবে না।
 
এটা মনে রাখা জরুরি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হেরে যাওয়া বাংলাদেশকে হেরে যাওয়ার দিকেই টেনে নিয়ে যাবে! পরাজয় শব্দটা এ প্রজন্মের থাকাও উচিত নয়।
 
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আইন বিষয়ক উপ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ।
 
বিবার্তা/মৌসুমী
 
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com