বুকে ছিল তাঁর চব্বিশটি গুলি। ডান হাতের তালুতে একটি। বাঁ পায়ের গোড়ার পাশে একটি। দুই রানের মধ্যখানে দুটি গুলি। গোসলের আগে তার গায়ের গেঞ্জি, পাঞ্জাবি, প্লেকার্ড লুঙ্গি, পাঞ্জাবির পকেটে রুমাল, তামাকের কৌটা, পাইপ পাওয়া যায়।
১৬ আগস্ট সকাল ন’টার দিকে টুঙ্গিপাড়ার পোস্ট মাস্টারের কাছে বার্তা আসে, পাঁচ ছয়টি কবর খুঁড়তে হবে, লাশ আসছে ঢাকা থেকে। পরে জানানো হয় ফোন করে, একটি কবর খোঁড়ার জন্য।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, সপরিবারে, একথা গ্রামবাসী জেনে গিয়েছিল আগেই, রেডিওর মাধ্যমে। হেলিকাপ্টারে বঙ্গবন্ধুর লাশ দুপুর ২টায় থানার মাঠে আনা হলে, অনেক লোক আসে দেখতে। কিন্তু কাউকেই কাছে ঘেঁষতে দেয়া হয়নি। শুধু ১৫/১৬ জনকে তার কফিন বহন করার জন্য রাখা হয়। কফিনের ভেতরে ছিল বড় বড় কিছু বরফের টুকরা, তাই সেটা হয়েছিলো আক্ষরিক অর্থেই খুব ভারী।
কফিন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আনা হলে, কফিন খোলা নিয়ে ফ্যাসাদ দেখা দেয়। এমনভাবে কফিনটা লাগানো হয়েছিলো যে সেটা খুলতে মিস্ত্রী পর্যন্ত আনতে হয়েছিলো। এতো ঝামেলায় না গিয়ে সেনারা কফিনসহ কবর দিতে চাইলে, তাড়াতাড়ি মিস্ত্রী ডেকে কফিন খোলা হয়।
এরপরে হালিম মৌলবিকে ডেকে বলা হয়, তাড়াতাড়ি কবর দেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু একজন মুসলমান, ওনাকে গোসল করাতে হবে, কাফন পরাতে হবে এবং জানাজা পরাতে হবে, আর যদি আপনারা বলেন যে বঙ্গবন্ধু শহীদ হয়েছে তাহলে এসবের দরকার নেই।
তখন তাদের ২০ মিনিট দেয়া হয় মাত্র- গোসল, কাফন, জানাজার জন্য।
শেখ সাহেরা খাতুন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালের রিলিফের জন্য রাখা শাড়ি দিয়ে কাফন বানানো হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর। আর গোসল করানো হয়েছিলো ৫৭০ কাপড়কাচা সাবান দিয়ে! অনেক লোক জমা হয়েছিল ততক্ষণে কিন্তু তাদের কাছে আসতে দেয়া হয়নি। আনুমানিক ৩৫জন লোক উপস্থিত ছিলেন (তিন সারি) বাংলার এই সর্বশ্রেষ্ঠ নেতার জানাজায়।
বঙ্গবন্ধুর যখন দাফনকাফন চলছিল তখন এতে অনেক সাধারণ মানুষ শরিক হতে চাচ্ছিল, কিন্তু আর্মিরা প্রচণ্ড বাধা দেয়। তারা ভাবছিল বেশি মানুষ এসে যদি লাশ ছিনিয়ে নেয়! সেদিন মানুষ যেমন আর্মিদের ভয় পাচ্ছিল, আর্মিরাও ভয় পাচ্ছিল সাধারণ মানুষদের, কখন জানি তারা ক্ষেপে ওঠে!
একজন রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যুর পর যে রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার কথা ছিল, সেটা বঙ্গবন্ধু পাননি। দাফন শেষ হওয়ার পর আর্মি অফিসারেরা সারিবদ্ধ হয়ে তাকে তিনবার স্যালুট করে চলে যায়।
তার জানাজায় হাজার হাজার মানুষ সামিল হতে পারেনি, কিন্তু কোটি কোটি মানুষ হয়েছিলো শোকে স্তব্ধ। তারা কাঁদেনি। তারা পাথর হয়ে গিয়েছিলো।
এরপর পুরো দুই দশক তার নাম উচ্চারণ ছিল নিষিদ্ধ। না রেডিও, না টেলিভিশন, না সংবাদপত্র- কোথাও ছিলেন না তিনি।
কালের পরিক্রমায় আজ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে।বাঙালি হয়েছে কলংকমুক্ত।সকলের দোয়ায় তার সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের তিন বারের প্রধানমন্ত্রী। দেশ আজ এগিয়ে চলছে নানা প্রতিকূলতার মাঝেও কারণ ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবেদিত নেতাকর্মীদের শোককে শক্তিতে পরিণত করার যে মনোবল ছিল তার ছায়া এখনকার যারা প্রকৃত কর্মী তাদের মাঝেও বহমান। আর আগামীদিনে সকল সরল-কঠিন দিনে তারাই জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার মূল হাতিয়ার।
লেখক: কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক
বিবার্তা/জিয়া