সেই ছো্ট্ট বেলা, উড়ন্ত শৈশব, দূরন্ত কৈশোর, বাড়ন্ত যৌবন এবং পড়ন্ত বেলার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে এমন কিছু মানুষ জীবনের অঙ্গে উপস্থিত হয়, আলো ছড়ায় যাদেরকে ইচ্ছা করলেও ভুলে থাকা যায় না। কোটি মানুষের মধ্যে বিশেষ কিছু মানুষ থাকে যাদেরকে কারণে-অকারণে মনে পড়ে, জ্বালাতে ইচ্ছা করে, একসাথে খুনসুঁটিতে মত্ত থাকতে ভালো লাগে, তাদের দ্বারা জ্বালাতন পেতে স্বাদ জাগে- এই মানুষগুলোই বন্ধু।
জীবনে বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন স্তরের, বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন প্রকৃতির বন্ধুর আবির্ভাব ঘটে। দৃষ্টিভঙ্গির সমতাই মূলত বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। প্রত্যেকের জীবনে এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের সংস্পর্শ-সহচর্য না পেলে জীবনটাই পাণসে মনে হয়। বন্ধুত্ব সেটাই যেখানে আলাদা দু’টি দেহের মধ্যে একটি অভিন্ন হৃদয় বাস করে। যার বন্ধু নাই সে চরম গরীব। বন্ধুত্বে কোন লোভ থাকে না, অহংকার-দ্বেষ জায়গা পায় না। প্রকৃত বন্ধুত্ব স্থাপিত হয় নিঃস্বার্থভাবে।
বন্ধুত্ব এমন এক বন্ধন যাকে কেন্দ্র করে একজন আরেকজনকে ভরসা-বিশ্বাস করতে পারে। বাবা-মা, ভাই-বোন, শৈশবের খেলার সাথী, শিক্ষাজীবনে সহপাঠী, পাড়ার অগ্রজ-অনুজ, কর্মক্ষেত্রের সহযোদ্ধা, যৌবনে স্ত্রী কিংবা দূর দেশের অচেনা মানুষও হতে পারে প্রকৃত বন্ধু।
বন্ধুত্বের পবিত্রতম রূপ প্রকাশ পায় বার্ধক্যে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ভরসা-ভালোবাসায়। বন্ধুত্ব কোন জাত-পাত-ধর্ম-গোত্র-বর্ণকে প্রধান দেয় না। রুচির এবং পছন্দের মিল ঘটলেই জন্ম নেয় প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। প্রকৃত বন্ধুত্ব ঘুঁচিয়ে দিতে পারে সকল অপ্রাপ্তির হতাশা, নাগাল দিতে পারে স্বর্গীয় আলোর সুধা।
বিপদে যে এগিয়ে আসে, দুঃখ-কষ্টের যে অংশীদার হয়, সুখে যারা আনন্দ করে- তারাই বন্ধু। ঘোষণা দিয়ে বন্ধুত্ব করা লাগে না। কালের চক্রে জীবন তরীতে এরা আপনা-আপনি জড়ায়।
বাংলাদেশে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলেও আজ অধুনা বিশ্বে উদযাপিত হচ্ছে বন্ধু দিবস। প্রতিবছরের আগস্ট মাসের পহেলা রোববার পালিত হয় বন্ধু দিবস। ইতিহাস স্বাক্ষ দেয়, ১৯৬৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে জাতিসংঘে যোগদান করে। এই দিবসে সিঙ্গাপুরের উপলব্ধি হচ্ছে, সিঙ্গাপুর সেই সব দেশের বন্ধু হতে চায় যারা তাদের বন্ধু হতে এগিয়ে আসবে। কেউ কেউ বলেন, সেখান থেকেই জন্ম বন্ধু দিবসের।
সব শ্রেণীর, সব বয়সের বন্ধুদের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য পালিত হয় আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস। শুভেচ্ছা জানানোর জন্য রয়েছে শুভেচ্ছা, উপহার, আলিঙ্গন, একসঙ্গে ছবি তোলা, আড্ডা দেয়া, ফূর্তি করা ইত্যাদিসহ কিছু প্রথাগত পদ্ধতি।
আমাদের বন্ধুত্ব চিরকালের, চিরায়ত। দিনক্ষণের তোয়াক্কা না করেই অগ্রগামী আমাদের সম্পর্ক। বিজ্ঞ বন্ধু জীবনের আশীর্বাদ। কাছে থাকি কিংবা দূরে বন্ধুত্বের আবেদনে কখনো জোয়ার-ভাঁটা হয় না। এ যেন এক সমান্তরাল টান। বিশ্বাস-আস্থাকে পূঁজি করে যে বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছে মরণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সে বন্ধন টিকিয়ে রাখতে ত্যাগ-ভোগ যা প্রয়োজন, তাতে কার্পণ্য করা বন্ধুত্বের দাবী নয়।
শৈশবের বন্ধুরা যেমন আমার কাছে বিশ্বাসের স্তম্ভ তেমনি জীবনের অন্য অংশের বন্ধুরাও সমগুরুত্বপূর্ণ। তবে জঘন্য শত্রুর চেয়েও তোষামোদকারী বন্ধু ভয়ঙ্কর- সে দিকে দৃষ্টি রাখা চাই। মিথ্যা প্রশংসা নয় বরং যে সমালোচনা করে, ভুল ধরিয়ে দেয় সেই প্রকৃত বন্ধু। বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকি চিরকাল।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
বিবার্তা/জিয়া