দায় মোচনের এখনই সময়

দায় মোচনের এখনই সময়
প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০১৬, ১৪:২০:৫৭
দায় মোচনের এখনই সময়
রেজা আকাশ
প্রিন্ট অ-অ+
বলা হয়ে থাকে, ‘যে জাতি গুণীদের কদর করতে জানে না, সে জাতিতে গুণী ব্যক্তি জন্ম নেয় না’- কথাটাকে একটু পরিবর্তন করে আমি বলি, ‘যে জাতি তার বীর সন্তানদের মূল্যায়ন করে না, সে জাতিতে কখনো বীর জন্ম নেয় না।’ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বাঙালি বীরের জাতি। তবে এদেশের পবিত্র মাটিতে বীর সন্তানের জন্ম যেমন হয়েছে তেমনি জন্ম নিয়েছে দেশবিরোধী মীর জাফর। 
দায় মোচনের এখনই সময়
বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল
 
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বীর সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করে বিশ্বমানচিত্রে অভ্যুদয় হয় স্বাধীনরাষ্ট্র  বাংলাদেশের।
 
বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সেসময় দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ২৪ বছরের পাকিস্তানি শোষণ, বঞ্চনা-লাঞ্ছনার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ৩০ লাখ মানুষের তাজা প্রাণ ও দুই লাখ মা-বোনের অসম্মানের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
 
অথচ সেই স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার চার বছর না পেরোতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কি নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী নরপিশাচ মীরজাফরের বংশধরেরা। 
দায় মোচনের এখনই সময়
বঙ্গবন্ধুর মেজ ছেলে শেখ জামাল
 
বাংলার মাটি থেকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ইতিহাস মুছে ফেলতে স্বাধীনতাবিরোধী সামরিক জান্তা ও স্বৈরাচারেরা শুরু করে একের পর এক প্রপাগান্ডা ও মিথ্যাচার। যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর ভিত্তি করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল তাকে অস্বীকার করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে থাকে পঁচাত্তর পরবর্তী তৎকালীন মোশতাক ও জিয়া সরকার। জিয়া সরকার রাজাকারদের জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকেন অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করতে শুরু করেন। সে সময় স্বাধীনতাবিরোধীদের অত্যাচারে মানুষ দীর্ঘদিন ‘জয় বাংলা/ জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানটিও প্রকাশ্য উচ্চারণে সাহস পেতো না। জাতির পিতা ও তার পরিবারকে নিয়ে মিথ্যাচার ছিল জিয়া সরকারের সবচেয়ে বড় অপরাজনৈতিক কূটকৌশল। জিয়া সরকার নিজেদের মর্জি মতো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখে গিয়েছিলেন। এরই কুফল হিসেবে কিছুদিন আগেও একটি প্রজন্ম স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে যেতো। আজো একটি শ্রেণী স্বাধীন বাংলাদেশে বসে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করে। বঙ্গবন্ধু পরিবার ও আওয়ামী লীগকে ভারতের ‘দালাল’ বলে গালমন্দ  করে তারা আনন্দবোধ করে।
দায় মোচনের এখনই সময়
দেওহাটা থানার মুক্ত এলকায় কর্ণেল ওসমানী স্থানীয় জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন। উপস্থিত ছিলেন বাঁ থেকে শেখ কামাল, ক্যাপ্টেন হুদা, জহির মাহমুদ স্বপন, তৃতীয় মুক্তিযোদ্ধা শওকত আকবর রিচি, সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিল, বিগ্রেডিয়ার শাহজাহান,  আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী খুরশিদ আলম, মি. আলম সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা
 
জাতির পিতার সেদিনের সে ডাকে সাড়া দিয়ে দেশমাতাকে হানাদারদের দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করতে দেশের মানুষের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে নেমেছিল বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য পুত্রদ্বয় শেখ কামাল ও শেখ জামাল। ১৯৭১ সালে ৯ অক্টোবর প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সে যোগদান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামাল। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি গেরিলা বাহিনী হিসেবে ‘মুক্তি বাহিনীর’ অন্যতম সংগঠক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট অফিসারদের একজন। ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর এদের পাসিং আউট হয়। এরপর সেকেন্ড লেফট্যানেন্ট শেখ কামাল প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানির এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শেখ জামাল পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে গৃহবন্দী ছিলেন। সেখান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুজিব বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে যুদ্ধ করেছেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুলাই ইবিআর (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে) এ জুনিয়র অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন শেখ জামাল। ব্যক্তিজীবনে তারা ছিলেন সঙ্গীত সাধক, খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষক, বুদ্ধিদীপ্ত কর্মঠ দুই তরুণ। পিতার সাথে কাঁধ মিলিয়ে যারা সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল। পঁচাত্তরের ১৫ ই আগস্ট পরিবারের সাথে এই দুই তরুণকেও হত্যা করা হয়। মুছে ফেলা হয় তাদের স্বল্পজীবনের বর্ণাঢ্য কর্মের ইতিহাস।
দায় মোচনের এখনই সময়
ছবিতে বাঁ থেকে , সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সিআর দত্ত, মুক্তিযোদ্ধা শওকত আকবর রিচি, সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম তনয় মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানি নৌকা থেকে নামছেন
 
আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধু পরিবারের ত্যাগের ইতিহাস স্বীকার করতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিদের অনেক কুণ্ঠাবোধ হয়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সংগ্রাম, ত্যাগ ও বীরত্বের ইতিহাস জাতির সামনে আসতে দিতে ভয় পায় তারা। প্রপাগান্ডা ও মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়। এই অবিশ্বাসীরা ভুলে যায়, বঙ্গবন্ধুর একটি মাত্র অনুরোধেই কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় লাভের মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে এদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য তুলে নিয়ে যায় সে সময়ের ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
 
ইসলামের মক্কা বিজয়ের ন্যায় বিনা রক্তপাতে ভারত সরকারের থেকে এক বাংলাদেশ সমান সমুদ্র সীমানা জয়, ছিটমহল বিলুপ্তের মধ্য দিয়ে নতুন মানচিত্র এঁকেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা যে আজ বাস্তব সেটির রূপকারও তো বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। অথচ শুধু বঙ্গবন্ধু নাতি, শেখ হাসিনার পুত্র বিধায় যথেষ্ট মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও জয়কে স্কলাসটিকা স্কুলের কিছু কিছু শিক্ষক নির্যাতন করতেন, পরীক্ষায় ইচ্ছাকৃতভাবে কম মার্ক দিতেন। সইতে না পেরে তিনি ভারতে যান পড়াশুনা করতে। বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারটিকে একসুতোয় গেঁথে রেখে, পর্দার পেছন থেকে নিরলসভাবে বঙ্গবন্ধুকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে গেছেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। আমরা কয়জন জানি, বঙ্গবন্ধু পরিবারের সেসব সংগ্রামের ইতিহাস।
 
যে কোনো যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার অবদানকে স্বীকার করে যেকোনো রাষ্ট্র তার সূর্যসন্তানদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়। বাংলাদেশও সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য বর্তমানে ৬৭৬ জন বীরত্বসূচক পদক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এর মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ রয়েছেন ৭ জন, বীর উত্তম ৬৮ জন, বীর বিক্রম ১৭৫ জন ও বীর প্রতীক ৪২৬ জন। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ২৯১ জন, নৌবাহিনীর ২১ জন, বিমানবাহিনীর ২৩ জন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ১১ জন, পুলিশ বাহিনীর ৫ জন এবং গণবাহিনীর ২১৮ জন যোদ্ধা রয়েছেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রক্ষার জন্য ৬১ বিদেশী নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই উদ্যোগ নিয়ে এই সম্মাননার আয়োজন করেন।
দায় মোচনের এখনই সময়
পল্টনের জনসভায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকি ও শেখ জামাল
 
অথচ দীর্ঘদিন ধরেই ইতিহাসের পাতায় বঙ্গবন্ধু দুই পুত্রের বীরত্বগাথা অনেকটাই অবহেলিত। যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের নেই কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধু পরিবারের ইতিহাস মুছে ফেলার অংশ হিসেবেই পঁচাত্তার পরবর্তী স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি জাতির এই দুই সূর্য সন্তানের অবদানকে মূল্যায়ন তো করেইনি বরং তাদের নামে অকথ্য মিথ্যাচার চালিয়ে গেছে। তবে বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস জানতে চায়। তাই জাতির সামনে সেসময়ের সব মিথ্যাচারের চরিত্র উন্মোচন হওয়া শুরু হয়েছে। এখন সময় এসেছে ইতিহাসের দায় মোচনের। বঙ্গবন্ধু পরিবারের নামে সকল মিথ্যাচারের সমুচিত জবাব দেয়া ও মিথ্যাচারকারীর মুখোশ উন্মোচন করার। সেই সঙ্গে চির তারুণ্যের প্রতীক বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল ও শেখ জামালের অবদানকে মূল্যায়নের জন্য মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা।
 
লেখক: সহ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ
 
বিবার্তা/ফারিজ/জিয়া
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com