একটি বিদেশি ব্যাংকে মাঝে মাঝে আমার যাওয়া হয়। সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গেও আমার বেশ ভালো সম্পর্ক। কিছুদিন আগে ব্যাংকটির ওই ব্রাঞ্চে একটি মেয়ে যোগদান করে। কমবয়সী। তাই একটা শিশুসুলভ ভাব সবসময় তার মধ্যে খেলা করে।
হবেই বা না কেন? ঢাকার একটি স্বনামধন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে এমবিএর চৌকাঠ পেরিয়ে মাত্রই সে চাকরিজীবনে প্রবেশ করেছে। নিতান্ত আটপৌরে বাঙ্গালী মেয়েদের মতো তার চলাফেরা নয়, এমনকি চিন্তাভাবনাও। মেয়েটির এই বিষয়টাই আমায় তাকে ভালো লাগতে বাধ্য করেছে।
এখানে মেয়েটিকে নিয়ে এত কিছু বলার একটি কারণ হলো, কয়েকদিন আগে ওই অফিসে মেয়েটিকে দেখে আমি আগের আর পরের মেয়েটির মধ্যে যে পার্থক্য দেখলাম তাকে হয়তো অনেকেই বলবেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! মেয়েটি হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে’।
গুলশানের হোটেল আর্টিজানে হামলার পর যে মেয়েটি জিন্স-ফতুয়া পরে অফিস করত আজ তার পোশাক আমাকে ব্যথিত করেছে। আটপৌরে অন্যসব নারীর মতো সে নিজের পোশাকটি পরিধান করেছে। তবে আচরণে তার সেই আগের সাবলীল ভাবটা নেই। আমার চোখে চোখ পড়তেই বলল, ‘আচ্ছা আপু, বলেন তো দেশের এই অবস্থা থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব? আমার আর এসব পরতে ভালো লাগে না। কিন্তু ভয় লাগে এই ভেবে যে, বাবা-মা’র কাছ থেকে আমি দূরে থাকি আর একা চলাফেরা করতে হয় বলে বেশ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। তাই এই পোশাক পরতে বাধ্য হয়েছি।’ করুণ মুখে আরো বললো,‘ জানেন আপু, ওদেরকে আমার খুব ভয় লাগে।’
আমি কিভাবে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করি জানতে চাইলে বললাম, আমি ভয় করি কেবল আল্লাহকে। আল্লাহর সৃষ্ট কোনো মানুষকে নয়। আমার যদি কোনো দূর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তবে সেটাও আল্লাহর ইচ্ছেতেই হবে। কোনো মানুষের ইচ্ছেতে নয়।’
আমার কথায় মেয়েটি এবার কিছুটা সাহসী হয়ে ওঠে। এবার বলে, হ্যাঁ আপু এবার আমি পারবো, আর ভয় লাগবে না।
এখন বিষয়টা হল আমাদের দেশে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে তাতে আমরা কাকে ভয় করব? সর্বশক্তিমান আল্লাহকে, নাকি নামমাত্র মুসলিম এই উদীয়মান জঙ্গিকে?
নব্য জঙ্গিবাদের উত্থান শুধুই কি বাংলাদেশে হয়েছে? মোটেই না; বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে জঙ্গিবাদ এখন একটি যন্ত্রণাদায়ক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু এতে যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো সব দায় এসে পড়ছে মুসলিমদের উপর। বর্তমানে ইসলামবিরোধী শক্তি, বিশেষ করে পশ্চিমারা ইসলামকে জঙ্গিবাদের সমার্থক হিসেবে প্রচার করে চলেছে।
আমরা সবাই জানি, ইসলাম শান্তির ধর্ম। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবকুলের শান্তি, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি, প্রগতি ও উন্নতির জন্য মনোনীত করেছেন ইসলাম ধর্মকে। অতএব একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিমের অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতার কারণ হতে পারে না। সুতরাং ইসলামের সাথে জঙ্গিবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী তৎপরতা দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
এ কথা সর্বমহলে স্বীকৃত যে, ইসলাম তার অন্তর্নিহিত স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, সম্প্রীতি, উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতার মাধ্যমে পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তরবারির জোরে, জঙ্গিবাদ কিংবা সন্ত্রাসের মাধ্যমে নয়। জিহাদের নামে বা ইসলামের নামে চলমান অরাজকতামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণ হারাম। বোমাবাজি, মানুষ হত্যা, সন্ত্রাস, ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি ও আত্মঘাতী তৎপরতা ইত্যাদি ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। যারা এগুলো করছে তারা বিভ্রান্ত এবং ইসলামবিরোধীদের ক্রীড়নক।
আর এসব ক্রীড়নককে ঠেকাতে হলে দায়িত্বটা প্রথমে নিতে হবে দেশের প্রতিটা পরিবারকে। যদি সার্ভে করা হয় কারা জঙ্গিবাদে বেশি জড়াচ্ছে তাহলে দেখা যাবে ইদানিং বেশ উঁচু (টাকার পরিমাণে) শ্রেনীর নাগরিকের সন্তানেরা এবং যাদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কের অংশীদারিত্ব নেই। এদের অনেকেরই আবার ধর্ম সম্পর্কে বিস্তর জানা নেই। আবার কেউ কম জানলে ভাবটা দেখান তিনি অনেক বেশি জানেন। আবার অনেকে এমন আছেন যে তিনি যা করেন তা ইসলামে সিদ্ধ কিন্তু ওই একই কাজ অন্য কেউ করলে সেটা হারাম।
ইসলাম ব্যবহারের এই বৈপরীত্বই এখন আমাদের বড় বাধা। এই বাধা পেরোতে হবে আমাদের সকলকেই; আর সেটা করতে হলে সবার আগে ইসলাম সম্পর্কে শুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। নয়তো সামনে মহাবিপদ।
আবারো ফিরে যাই আমার দেখা সেই মেয়েটির কাছে, যার অধিকার আছে নিজের ইচ্ছেমতো পোশাক পরে ঘুরে বেড়ানোর। লেকের পাড়ে বসে বন্ধুদের সঙ্গে চটপটি ফুচকা খাওয়ার কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি করে ইয়েস বাডি বলে গাল টেনে দেয়ার। কিংবা নিদেনপক্ষে নিজের পছন্দমত পোশাক পরে স্বাধীনভাবে চলার সুযোগটুকু তার থাকা চাই, তাই না? আর এটা সম্ভব হবে তখনই যখন আমরা জঙ্গিরূপী কিছু নরখাদককে নয়, কেবল সর্বশক্তিমান আল্লাহকেই ভয় করব।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন