জাতির জনকের কর্মময় জীবন থেকে শিক্ষা নিই

জাতির জনকের কর্মময় জীবন থেকে শিক্ষা নিই
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০১৬, ১৬:০৫:২৫
জাতির জনকের কর্মময় জীবন থেকে শিক্ষা নিই
ফারহানা ইয়াছমিন জুঁথী
প্রিন্ট অ-অ+
১৯৪৩ সাল। বঙ্গবন্ধুর বয়স তখন মাত্র ২৩ বছর। তাঁর জীবন পরিচয়ে ১৯৪৩ সালকে বলা হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। ওই বছরে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। 
 
জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও ১৯৪৩ সালের অনেক গুরুত্বপূর্ণ  তথ্য পেলাম। মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে বিচলিত হয়ে যান ২৩ বছর বয়সী  শেখ মুজিবুর রহমান,  ছুটে যান এমন মানুষের কাছে, যারা এই অবস্থা থেকে মানুষকে  দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচাতে পারবে। 
 
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সীমাহীন কষ্ট ও মানবতাবাদের জাগরণ  - এ সকল কিছু পূর্ববঙ্গের ইতিহাসে আলাদা এক মাত্রা যোগ করেছে। এ সময়ের ভয়াবহতার চিত্র বঙ্গবন্ধুর লেখনীতেও উঠে এসেছে : ‘১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ লোক মারা যাচ্ছে। এই সময় আমি প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হই।...১৯৪৩ সালে, খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি তাঁর ছোট ভাই খাজা শাহাবুদ্দীন সাহেবকে শিল্পমন্ত্রী করলেন। আমরা বাধা দিলাম, তিনি শুনলেন না। শহীদ সাহেবের কাছে আমরা যেয়ে প্রতিবাদ করলাম, তিনিও কিছু বললেন, না। সোহরাওয়ার্দী সাহেব সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী হলেন। দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটছে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে। খাবার নাই, কাপড় নাই। ইংরেজরা যুদ্ধের জন্য সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। ধান-চাল সৈন্যদের খওয়াবার জন্য গুদাম জব্দ করেছে। যা কিছু ছিল ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করেছে। ফলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দশ টাকা মণের চাউল চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করছে। এমন দিন নাই রাস্তায় লোকে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় না।’
 
মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে বিচলিত হয়ে যুবক মুজিব ছুটে যান এমন মানুষের কাছে যারা এই অবস্থা থেকে মানুষকে ন্যায্য পাওনা দিয়ে দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচাতে পারবে। দুর্ভিক্ষ কেমন করে, কারা, কেন ঘটাচ্ছে আর মানুষকে জিম্মি করে দেশকে কোন অবস্থায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে তাও তিনি ছাত্রলীগ করা বয়সেই বুঝতে পেরেছিলেন। শুধু যে বুঝতে পেরেছিলেন তা নয়, এর থেকে পরিত্রাণের পথও খুঁজে বের করে পরিকল্পনা করে, আরো অনেককে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছেন আর এভাবে বিশ্বমানবতার জন্য কাজের ধারার পথ কণ্টকমুক্ত করেছেন। 
 
সম্পদে ভরা বাংলার তখনকার দুরবস্থা তিনি নিজের চোখে দেখেছেন, আর বর্ণনা করেছেন : ‘মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মার দুধ চাটছে। কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবারের জন্য কাড়াকাড়ি করছে।’
 
এমন করুণ অথচ সত্য অনেক ঘটনা তাঁর বর্ণনায় উঠে এসেছে, যা পাঁচ যুগ পেরিয়ে আসার পরও আমাদের চোখে অশ্রু ঝরায়, মনকে বিষাদময় করে তোলে। বিশেষ কয়েকটি কারনে ১৯৪৩ সালটি আমাদের কাছে কষ্ট ও মানবতাবোধের সমন্বয় বলে মনে হয়েছে। এর মধ্যে জাতির জনকের লেখাপড়া ছেড়ে আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করা অন্যতম। 
 
আরও একটি কারণ হিসেবে আমি দেখাতে চাই শিল্পাচার্যের সেই শক্তিশালী চিত্রকর্মের সিরিজ। যারা জয়নুল আবেদীনের সেই দুর্ভিক্ষের বা মন্বন্তরের চিত্রগুলো দেখেছেন তারা আমার সঙ্গে একমত হবেন, বঙ্গবন্ধুর দুর্ভিক্ষের বর্ণনা আর শিল্পাচার্যের চিত্রের ভাবার্থ একই বিষয় উপলব্ধিকৃত। জয়নুল আবেদীন খুব সাবলীলভাবে, জটিলতা এড়িয়ে, রেখার সাহায্যে, সস্তা কাগজে, কালো রংয়ের আঁচড়ে দূর্দান্ত গতিতে একেঁছেন ‘তেতাল্লিশের মন্বন্তর’। তাঁর মতামতও ছিল একই, এ দুর্ভিক্ষ মানুষের সৃষ্ট। 
 
একটা পরাধীন দেশে একটি বিদেশি শক্তির চক্রান্ত, ইংরেজদের সৃষ্ট এ দুর্ভিক্ষে মানুষ অনাহার, অপুষ্টি ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। জয়নুলের চিত্রে ফুটে ওঠে একের পর এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ডাস্টবিনের উচ্ছিস্ট থেকে খাদ্য অন্বেষণের তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে মানুষ, কুকুর আর কাকের মধ্যে। অনাহারে মৃতপ্রায় মানুষ, মৃত মানুষের কংকালসার দেহ, অনাহারে মৃত জননীর স্তন পানের চেষ্টা করছে ক্ষুধার্ত শিশু, এমনি বাস্তব কিন্তু নির্মম বাস্তব কিছু চিত্র। যা পরবর্তীতে পরিণত হলো অমূল্য সম্পদে। এ চিত্রগুলো তখন এদেশের পরিস্থিতি সারা বিশ্বে তুলে ধরতে সাহায্য করেছিল। 
 
মাত্র ২৩ বছর বয়সে কি দূর্বার, অকুতোভয় প্রানে এগিয়েছেন মানুষের মঙ্গলের জন্য। এজন্যই তিনি বাংলার বন্ধু - বঙ্গবন্ধু। পরবর্তী সময় দেশ গড়ার সময় খুঁজে সঙ্গে নিয়েছিলেন এ দেশের আরেক রত্ন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনকে। পেশাগত, শিক্ষার বিষয়গত, এমনকি বয়সেরও পার্থক্য যেখানে ছিল সেখানে স্বার্থের অগোচরে দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা একসূত্রে গাঁথা ছিল। আর বঙ্গবন্ধুর মতো বিচক্ষণ মানুষ এমন ব্যক্তিত্বকে পাশে রাখতে কুন্ঠিত হননি কোনোদিনও। 
 
আমি শিক্ষা নিই আমার জাতির জনকের কর্মময় জীবন থেকে, সামনে এগিয়ে যাই শিল্পগুরুর দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে। হে দেশরত্ন, আমাদের সম্মুখগতির ধারক আমাদের মুক্তির আলোয় পথ দেখানোর জন্য কৃতজ্ঞ। 
 
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ও সংস্কৃতি কর্মী।
 
বিবার্তা/মৌসুমী
 
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com