১৯৭৫। সবে প্রাইমারী স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে পা রেখেছি। বেশ ভালোই লাগছিলো হাই স্কুলের ছাত্র হিসেবে। তখন আমাদের এলাকায় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় বড় দু’বোন একই স্কুলের নবম কিংবা দশম শ্রেণীর ছাত্রী এবং ছাত্রলীগের স্কুল শাখার নেত্রী।
বড় বোনদের সঙ্গে স্কুলে যেতাম। দিনটি ছিলো শুক্রবার। ১৫ আগস্ট। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্কুলের যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখন শুক্রবার মানে হাফ স্কুল। জুম্মার নামাজের জন্য সকাল আটটায় স্কুল শুরু হতো আর সাড়ে এগারটায় শেষ হয়ে যেতো।
স্কুলে যাবার পূর্বমুহূর্তে বাবা বললেন স্কুলে না যাবার জন্য। দেখলাম বাবার মুখ প্রিয়জন হারানোর বেদনায় বিমর্ষ। তিনি কাঁদছেন আর রেডিওর সংবাদ শুনছেন।
আমাদের বাড়িতে তখন ব্রাউন চামড়ায় আবৃত একটি ফিলিপস কম্পানির থ্রি-ব্যান্ডের রেডিও ছিলো। রেডিওটা মাঝেমধ্যে যান্ত্রিক বিভ্রাট করতো। সেদিনও সমস্যা দেখা দেয়াতে বাবা রাগে রেডিওটা ভেঙ্গে ফেলার মতো অবস্থা করছেন।
প্রথমে স্কুলে না যাবার নির্দেশ শুনে আনন্দে মেতে উঠেছিলাম। কি মজা! স্কুলে গিয়ে স্যারের ধমক খেতে হবে না, সারা দিন মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরবো সারা গ্রাম, সহপাঠী আর বন্ধুদেরে নিয়ে থাকবো খেলায় মত্ত। কিন্তু একটু পরেই যখন দেখলাম সারা গ্রামের অনেক মানুষ আমাদের বাড়িতে সমবেত হচ্ছেন এবং খুবই নিচু কাঁপা কাঁপা স্বরে সেই ভয়াবহ ঘটনা সর্ম্পকে আলাপ করছেন।
মা আমাকে বললেন বাড়ি থেকে না বের হবার জন্য। দেশে হয়তো গণ্ডগোল লেগে যেতে পারে।
বাবাসহ গ্রামের অনেক মানুষের বেদনাবিধুর আর বিমর্ষতা দেখে আমার কৈশোরের চোখেও বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে দেশে একটি বড় রকমের অঘটন ঘটে গেছে। পরে জেনেছি, বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কতো মিছিল, কতো মিটিং। এছাড়াও বড়ভাই আর বাবার মুখে শুনেছি বঙ্গবন্ধুর কতো কথা। বঙ্গবন্ধু যখন সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় মিটিং করতেন তখন বড়ভাই শ্রীমঙ্গল কলেজের ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কর্মী। ফলে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সভায় যাবার সুযোগ হতো তার। তিনি যেতেন এবং বাড়ি এসে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কতো গল্প করতেন। আমরা সব ভাই-বোন অপলক চোখে বড়ভাইয়ের কথা শুনতাম।
যাক, ১৯৭৫ সালে রাজনীতি ভালো করে বুঝতাম না। শুধু মাঝেমধ্যে স্কুলের উপরের ক্লাসের বড় ভাইবোনদের সঙ্গে শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরীতে কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের র্যা লিতে অংশগ্রহণ করে ‘জয় বাংলা’‘জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান দিয়ে বড়দের কন্ঠে কন্ঠ মিলাতাম, মিছিল করতাম।
আগষ্ট ট্রাজেডির সকাল বেলা বাড়ি ভরা মানুষ আর ভয় ভয় চোখে বাবার পাশে বসে বড়দের চোখে জল দেখে নিজেও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। সেই অভিশপ্ত সকাল বেলার কথা তখন এতো বেশি করে উপলব্ধি করতে পারিনি। আমি সেদিন ভয় ভয় চোখে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাবা কেন এমন করছেন, কি হয়েছে? শেখ মুজিব তো আমাদের কোনো আত্মীয় নন, কিংবা গ্রামেরও কোন লোক নন তা হলে বাবা গ্রামবাসী আর বড় বোনরা কাঁদছে কেন, আমাদের বাড়িতে এত মানুষ সমাগম হচ্ছে কেন? মা বলেছিলেন, ‘ও তুমি বুঝবে না-বড় হলে বুঝবে। শেখ মুজিব সবার আত্মীয়, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং একজন বড় নেতা।
সেদিন জাতির জনক হত্যার বিষয়টি ভালো করে না বুঝলেও কয়েক বছর পরই বুঝতে অসুবিধা হয়নি ১৯৭৫-এর সেই কালো রাতে কি ঘটেছিলো। কী কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটেছিলো বাংলাদেশে, কী ভয়ানক ধ্বংসের মাতমে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো মানুষের ভাষা, বাকরুদ্ধ হয়েছিলো গোটা দেশবাসী।কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষ ছিলো বিপন্ন, ভারাক্রান্ত। জনক হারানোর শোকে স্তম্ভিত।
মনে আছে ১৫ আগস্টের ২/৩ দিন পর স্কুলে গিয়ে দেখি প্রধান শিক্ষকের অফিসে টাঙ্গানো বঙ্গবন্ধুর ছবি নেই। অনেকদিন পর জানতে পেরেছিলাম অনেকদিন পর জানতে পেরেছিলাম, ১৫ আগস্ট সকালেই শিক্ষকরা বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে অফিসের কাঠের আলমারির পেছনে লুকিয়ে রেখেছেন।
১৫ আগস্টের পরপরই লুকায়িত উইপোকার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে স্বাধীনতাবিরোধীরা গর্ত থেকে বের হয়ে অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির উপর।
মনে আছে, কমলগঞ্জ হাই স্কুলের পাশেই ছিলো থানা। থানার ভিতরে ছিলো বিশাল একটি তমাল গাছ। সেই তমাল গাছে হাত-পা-চোখ বেঁধে কী মধ্যযুগীয় বর্বর নির্যাতন করতে দেখেছি কমলগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ক্যাপ্টেন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গফুর চাচা(বর্তমানে প্রয়াত) এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা বিধান দাসসহ অনেককেই। আমার বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবুল এবং পাশের বাড়ির মুক্তিযোদ্ধা মিহির কাকুকে পুলিশ খুঁজছিলো। বাবা দেশের অবস্থা ভয়ানক হবে ভেবেই বড় ভাই আর মিহির কাকুকে এলাকার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমার বড়ভাইয়ের মুখ থেকে পরে শুনেছিলাম শ্রীমঙ্গলের খ্যাতনামা জননেতা, পরবর্তীতে উপজেলা চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতা ইসমাইল হোসেন (বর্তমানে প্রয়াত) ও শ্রীমঙ্গলের সাবেক পৌরসভা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিমকে পুলিশ অমানুষিক নির্যাতন করে হাত-পা ভেঙ্গে দিয়েছিলো।
এটা শুধু একটি এলাকার কথা তুলে ধরলাম। এভাবে সারা দেশে আতংক সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করার জন্য খুনিরা মেতে উঠেছিলো।
১৫ আগস্টের ৩/৪ দিন পর দেখেছি আমাদের এলাকার কুখ্যাত রাজাকার মুজিবুর রহমান কমরু মিয়া (পরবর্তীতে ইউপি মেম্বার) ও আনোয়ার খানদের (পরে উপজেলা চেয়ারম্যান) উত্থান, দেখেছি তাদের হাতে কী করে নির্যাতিত হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকদের। থানার পুলিশের নির্যাতনের ভয়ে এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছিলো।
১৫ আগস্টের সেই কলংকিত ভোর আমার বিবেককে দংশিত করেছিলো। সেই দুঃসহ স্মৃতি আমার মনে যে ক্ষত হয়েছিলো সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে যাবার ফলে ক্রমান্বয়ে বঙ্গবন্ধু ভক্ত হয়ে সত্যিকারের বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক হয়ে ছাত্র/রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ি। এই রাজনীতি করতে গিয়ে জীবনের কতো চড়াই-উৎরাই পেরুতে হয়েছে, জেল-জুলুম-অত্যাচার সইতে হয়েছে। মৃত্যুর মুখোমুখি থেকে কতোবার বেঁচে গিয়েছি।শরীরের অসংখ্য ক্ষতচিহ্ণ এখনো আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই দুঃসহ দিনগুলোর মাঝে।
প্রায় ৪১ বছর হলো স্বাধীনতাবিরোধী বাংলাদেশের কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করলো।এই ৪১ বছরে আমরা কি পেলাম আর কি হারালাম তা এখন ভেবে দেখার সময়। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ চিরসত্য অবিচ্ছেদ্য, যা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তিনি ছিলেন বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন দ্রষ্টা।
প্রবাসের কষ্টকঠিন সময়ে ১৫ আগস্টের সেই স্মৃতি আমাকে কাঁদায়। ২৪/২৫ বছর ধরে প্রবাস জীবনে জাতীয় শোক দিবসে একান্ত নীরবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। কম্পিউটারে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ বাজিয়ে শতাব্দির অমর কাব্যখানি পরিবারের সবাইকে নিয়ে শুনি। এদেশে জন্ম নেওয়া আমার সন্তানদের বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ সর্ম্পকে বলি। আমার ঘরের দেয়ালে লাগানো বঙ্গবন্ধুর ছবিগুলো দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুর গল্প বলি। যে নেতার জন্ম না হলে হয়তো বিশ্বের মানচিত্রে আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ পেতাম না, আজ আমরা প্রবাসের মাটিতে গর্ব করে বলতে পারতাম না, আমরা বাঙালি, বাংলাদেশ আমাদের দেশ, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা।
যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে, যতদিন পৃথিবীর চন্দ্র-সূর্য থাকবে ততোদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন শতাব্দি থেকে হাজার লক্ষ বছর অনন্তকাল মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায়। বাঙালির হৃদয়ে তিনি আকাশের মতো ভালোবাসা আর মহাসাগরের মতো শ্রদ্ধা নিয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল, শতাব্দি থেকে শতাব্দি, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
জাতির জনকের তিরোধান দিবস শোকাবহ আগস্টে তাঁর প্রতি রইলো আমার বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : প্রধান নির্বাহী, কানাডা-বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি (সিবিএনএ)
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন