উদ্ভট জাতিতে পরিণত হচ্ছি আমরা

উদ্ভট জাতিতে পরিণত হচ্ছি আমরা
প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০১৬, ১৭:৪২:৩৫
উদ্ভট জাতিতে পরিণত হচ্ছি আমরা
গুলশাহানা উর্মি
প্রিন্ট অ-অ+
১৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির জীবনে এক কলংকিত দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের বুকে 'বেঈমান' জাতি হিসেবে চিহ্নিত হই আমরা। এ কলঙ্কের দাগ আমরা বাকি জীবনে কখনও মুছতে পারবো বলে মনে হয় না। 
 
দেশীয় রাজনীতিতে বিরোধী অংশের কাদা ছোড়াছুড়ি কিংবা আস্ফালন আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। সে প্রসঙ্গে নতুন করে বলার কিছু নাই। এসব নোংরামি দেখে দেখে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
 
কষ্ট লাগে তখন, যখন দেখি আমাদের চেতনাকে পুঁজি করে একদল সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী, দুধের মাছি এককথায় দালালরা ফায়দা নেয়। চারিদিকে এখন দুধের মাছিদের জয়জয়কার। এটাও মোটামুটি গত আট বছরে আমাদের চোখসওয়া হয়ে গেছে। 
 
আর ইতিহাস থেকে আমরা জেনেছি এটাই স্বাভাবিক, এটাই আমাদের নিয়তি...এই ট্রেন্ডও নতুন নয়; সদ্যস্বাধীন দেশে ‘বঙ্গতাজ’কে কী ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তার সাক্ষ্য ইতিহাসের পাতায় খচিত হয়ে আছে। যুগ যুগ ধরে এসব দুধের মাছিই অ্যাকটিভ থাকে দল ক্ষমতাসীন থাকলে....যতোটা না আমরা দুর্দিনে থাকতে পেরেছি (এদের ভাব দেখে আমার তাই মনে হয়েছে)। 
 
আমার দুঃসময়ের সহযাত্রী-সহযোদ্ধাদের অধিকাংশর ফেসবুকের স্ট্যাটাসেই  এই বিষয়ে লেখা দেখি। এটা নিয়েও যে আমি মর্মাহত তাও না। এটাও মনকে মানিয়ে নিতে বলেছি। 
 
মর্মাহত হই তখন, যখন দেখি ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে সবাই ‘শো অফ’ করা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। শুধু ‘শো অফ’ বলবো না, ১৫ আগস্ট যেন  রীতিমত উৎসবের রূপ নিয়েছে। 
 
এ প্রসঙ্গে আমার ছোট একটা ঘটনা মনে পড়ে গেলো।‘আমার নানা যখন মারা যান, তখন আমার এক খালাত বোনের বয়স ছিলো ৫/৬ বছর। নানা মারা যাওয়ার পর সব আত্নীয়-স্বজন একসাথে হওয়ায় ও খুব মজা পেয়েছিল। নানা মারা যাওয়ার ২/৩ বছর পর নানী খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন আমার ওই খালাত বোন বলল 'নানা মরার পর আর কী আমুদ (আনন্দ) হইছিলো; আমুদ হবে তো নানী মরার পর।’ বর্তমানে এদের চিন্তাধারার সাথে আমার সেই ছোট্ট অবুঝ কাজিনের চিন্তাধারার খুব বেশি পার্থক্য দেখি না।
 
১৫ আগস্টে একেক জনের ছবি, সাজগোজের বাহার আর ফেসবুকে  স্ট্যাটাস দেখে মনে হয়, এটাও যেন খুব আনন্দের একটা দিন। শুধু ফেসবুক কেন, আমি নিজে ৩২ নাম্বারে ভোর সাড়ে ৫টায় উপস্থিত হয়ে দেখেছি, দলের সিনিয়র নেতা থেকে শুরু করে পাতি নেতা, চেলা নেতা, ভাই নেতা, ডিজিটাল নেতা (ফেসবুক), মাছি নেতা সবাই শো অফসহ আনন্দমুখর পরিবেশে উপস্থিত হয়েছেন। সাদা-কালো পোশাক পরে বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করে সিনিয়রের সাথে ৩২ দাঁত বের করে সেলফি তোলা, টিভি ক্যামেরা দেখলে প্যারালাইজড রোগীর মতো স্ট্যাচু হয়ে যাওয়া, ফুল দেয়ার সময় শক্তি প্রদর্শন করে ধাক্কাধাক্কি করা - সবই যেন রেওয়াজ হয়ে গেছে। 
 
এ তো গেল সকাল বেলার দৃশ্য। বিকাল বেলাটা কাটে আরও আনন্দে। পেটপুরে কাঙ্গালি ভোজের নামে ভুনা-খিচুড়ি, মাংস, কোল্ড ড্রিংকস পান করে শরীর চাঙ্গা করে আলোচনা সভার নামে বৈকালিক গেট টুগেদার চলে। সাথে থাকে ৩২ পাটি বের করে দল বেঁধে সেলফি। 
 
আমার বাসার পাশে মাইকে ভেসে আসছিল 'প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ' গানটি। গান বাজাতে হবে তাই বাজানো। 
 
একটু আগে একটি ভিডিওলিংক পেলাম, ব্যানারে শোক দিবস লেখা আর সামনে 'খুব চেনা চেনা' গানের সাথে এক কিশোরীর উদ্দাম-অশ্লীল নৃত্য ।    
 
আরও একটি ঘটনা মনে পড়ল। আমার এলাকার এক লোক শবেবরাতের রাতে রাস্তায় হেঁটে সিগারেট টানছিল। পথে একজনের সাথে দেখা। সে তাকে বলল 'ভাই, এতো রাতে রাস্তায় হাঁটতেছেন'? সে তখন বলল, 'ভাই জাগনা (রাত জেগে ইবাদতের রাত) রাত তো, তাই রাতের বেলা জাগতেছি। ঘরে শুয়ে থাকলে ঘুম ধরে, তাই রাস্তায় বের হইছি'। 
 
শোক দিবস তাই কিছু এ্যাকটিভিটি শো করা; তা সে যেমনি হোক।
 
মোটকথা, দিনকে দিন আমরা উদ্ভট-অদ্ভুত জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছি। আমাদের জীবনে আনন্দের ঘটনা খুব কম; তাই বলে কি সবকিছুতেই আমাদের আনন্দ খুঁজতে হবে?
 
আমরা পরপারের হুর-পরীর জন্য মানুষ মারতে তো পারিই; এমনকি নিজের জীবনের মায়াও ত্যাগ করতে পারি। আমাদের কেউ কেউ আবার সেই উদ্ভট স্মার্ট হ্যান্ডসামদের উপর ক্র্যাশ খায়। রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে ডিজিটালাইজেশন, রাজনীতি ঢুকে গেছে ফেসবুক আর সেলফিতে। ভালোবাসা-আবেগ সব হয়ে গেছে মেকী আর লোকদেখানো। ফেসবুক, ভাইবার, ইমোর কল্যাণে কে যে কখন কাকে 'আইলাবু জান' লিখছে, বলছে তার হিসেব তাদের নিজেদের কাছেও নাই। স্মার্টনেস আর আধুনিকতার নামে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের নিজস্বতা। এসব অরাজকতা দেখারও কেউ নাই, বলারও কেউ নাই। 
 
দিনকে দিন এসব দেখি আর আমার বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে ভাবি, এতো কষ্ট করে ভালোবেসে ওদের কী হিসেবে বড় করছি? ওরাও কি  আরেকটু বড় হয়ে এসব উদ্ভট-অদ্ভুতদের দলে নাম লেখাবে?
 
লেখক : মনিটরিং অফিসার, প্রেস উইং, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়
 
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন
 
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com