বঙ্গবন্ধু একই সাথে ইতিহাসের সৃষ্টি ও স্রষ্টা। শুধু বাঙ্গালির ইতিহাস নয়, বিশ্বইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি। তিনি এমন একজন নেতা, যিনি শুধু স্বপ্নদ্রষ্টা নন, স্বপ্নের রূপকারও বটে।
আমরা বিশ্বাসঘাতক, আত্মঘাতী বাঙ্গালি। যিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকালের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা উপহার দিয়েছেন, আমরা তাঁকে হত্যা করেছি।
১৫ আগস্ট শুধু শোক প্রকাশের দিন নয়, শক্তি ও সাহস সঞ্চয়েরও দিন। পৃথিবীতে আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, জন এফ. কেনেডি, মার্টিন লুথার কিংসহ অসংখ্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের নজির রয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের মহানায়ক, বাংলাদেশ নামক জাতি-রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পুরো পরিবারকে যে নৃশংসতায় হত্যা করা হয় তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল।
বঙ্গবন্ধু কেবল এই ভূখণ্ডের একজন অবিসংবাদিত নেতাই ছিলেন না; বরং ধাপে ধাপে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালিদের সুখ-দুঃখ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তিনি এমন কোনো গতানুগতিক রাজনীতিবিদ ছিলেন না, যারা কেবল নির্বাচনে জয়-পরাজয়কে কেন্দ্র করে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ করেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপন লক্ষ্য নির্ধারণ এবং তা অর্জনে স্থির ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই জন্যই ক্রমান্বয়ে তিনি হয়ে ওঠেন টুঙ্গীপাড়ার খোকা থেকে রাষ্ট্রনায়ক, যিনি পরবর্তী প্রজন্মের উজ্জ্বল ভবিষ্যত ও বাঙালিদের স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রের জন্য তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকালের দীর্ঘ ১৪ বছর অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে কাটান।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড শুধু কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা নয়; বরং তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে ওঠা চেতনা, ঐক্য ও সদ্য জন্ম নেয়া শিশু রাষ্ট্র বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে ভূলুণ্ঠিত করে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়াই ছিল ওই ভাড়াটে খুনিদের মূল উদ্দেশ্য। তবে এই ভাড়াটে খুনিদের পেছনে ছিল দেশী-বিদেশী অনেক ষড়যন্ত্রকারী। সে জন্যই সমাজচিন্তক সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে আমরা ঈর্ষা করেছি আমাদের অতিক্রম করে বড় হওয়াতে। সবদিকে বড় - তেজে, সাহসে, স্নেহে, ভালোবাসায় এবং দুর্বলতায়। এবং সেই ঈর্ষা থেকেই আমরা তাঁকে হত্যা করেছি। কেবল এই কথাটি বুঝিনি যে, ঈর্ষায় পীড়িত হয়ে ঈর্ষিতের স্থান দখল করা যায় না। তাই তো এই ভূখণ্ডে মুজিবের স্থায়ী অবস্থান মধ্যগগনে এবং তাঁর নাম শুনে শোষকের সিংহাসন কাঁপে।’
প্রতি বছর যখনই আগস্ট মাস আসে তখনই অবচেতন মনে কখনো আমরা হয়ে উঠি প্রচণ্ড সংক্ষুব্ধ, কখনো আবার স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় নীল, কখনো বা শোককে শক্তিতে পরিণত করে হই প্রচণ্ড আশাবাদী।
১৫ আগস্টের নৃশংসতার বর্ণনা দিতে গিয়ে সাহিত্যিক আবুল ফজল তাঁর শেখ মুজিব : তাঁকে যেমন দেখেছি গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সেদিনের ভোররাত্রির নির্মমতা কারবালার নির্মমতাকেও যেন ছাড়িয়ে গেছে। কারবালায় দু’পক্ষের হাতে অস্ত্র ছিল, তারা ছিল পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। আর সে হত্যা কোনো অর্থেই ঠাণ্ডা রক্তে ছিল না। সৈনিকের পেশা শত্রুনিধন, তাঁর হাতের অস্ত্র উত্তোলিত হয় শত্রুর বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে। সে যখন হত্যা করে, তখন তা নৈতিক নিয়ম-কানুনের আওতায় থেকেই তা করে। সৈনিক তো খুনি নয় – তাঁর হাতের অস্ত্র নিরস্ত্র নিরপরাধের ওপর উদ্যত হয় না। অথচ ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবের বাড়িতে তা-ই ঘটেছে। এ দিনের অপরাধ আর পাপ সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে বলে আমাদের আতঙ্কটা বেশি। কারণ, বৃহৎ অপরাধ আর বৃহৎ পাপ বিনা দণ্ডে যায় না। বাংলার মানুষকে সে দণ্ড একদিন একভাবে না একভাবে ভোগ করতেই হবে। এটিও আমার এক বড় রকমের আতঙ্ক।’ বাংলাদেশ এখনো তাঁর জনক হত্যার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তার সমগ্র জীবনের সাধনার আরাধ্য ধন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। তিনি এসে দেখেন মাত্র নয় মাসে পাকিস্তানী হায়েনারা তার স্বপ্নের দেশকে শ্মশানে পরিণত করেছে। কঠোর পরিশ্রম ও নেতৃত্বের দূরদর্শিতায় মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে যখনই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনসহ উন্নয়নের রোডম্যাপে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই আসে সেই ভয়াল কালো রাত। জনক হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ উন্নতি, প্রগতি, সমৃদ্ধি ও মর্যাদায় অনেক পিছিয়ে পড়ে। এমনকি কাছাকাছি সময়ে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ মালয়শিয়াও বর্তমানে অনেক মানদণ্ডে আমাদের থেকে এগিয়ে। কারণ, দীর্ঘ ২২ বছর তারা পেয়েছে তাদের রূপকার মাহাথির মোহাম্মদকে। আর আমরা পেয়ে হারিয়েছি আমাদের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক জাতির জনককে।
সারা পৃথিবীর সব সভ্য দেশের নেতৃত্ব ও জনগন বার বার ধিক্কার জানিয়েছে এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডকে। আমাদের চিনেছে অকৃতজ্ঞ ও কলঙ্কিত জাতি হিসেবে। শুধু দু’একজন ভাড়াটে খুনিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর মাধ্যমে জনক হত্যার এই কলঙ্ক ঘুচবার নয়। তাঁর আত্মার শান্তি ও কলঙ্কমোচনের জন্য প্রয়োজন তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলার বাস্তবায়ন ও গরীব দুঃখী মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। সর্বোপরি শোষণমুক্ত উন্নত এক বাংলাদেশ গঠন, যার স্বপ্ন তিনি আমৃত্যু লালন করেছেন।
তাঁরই সুযোগ্য উত্তরাধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে নিচ্ছেন। যারা এক সময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করেছে আজকে তারাই বাংলাদেশকে উন্নয়নের বিস্ময় হিসেবে প্রশংসা করছে। এসবই সম্ভব হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে, যিনি প্রমাণ করেছেন তিনি শুধু জাতির জনকের রক্তের নয়; আদর্শেরও শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার।
খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে হত্যা করতে পারলেও তার আদর্শ, চেতনা ও স্বপ্নকে হত্যা করতে পারেনি। যার জন্য বাঙালিরা আজও যখনই কোনো দুর্দিনের মুখোমুখি হয়, তখনই অনুপ্রেরণা খোঁজে তার সাহসী, ত্যাগী ও সংগ্রামী জীবন থেকে।
শরীর নশ্বর, কীর্তি অবিনশ্বর। তাই তো মুজিব মৃত হয়েও জীবিত। কারণ, মুজিব মানে লাল-সবুজের পতাকা, মুজিব মানে ১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গমাইলের ভূখণ্ড, মুজিব মানে বিশ্ব মানচিত্রের বুকে আমার মানচিত্র, মুজিব মানে বাংলাদেশ।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিতাড়নের জন্য এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা বিলুপ্ত ও কালোদের অধিকারের জন্য আব্রাহাম লিংকন ও মার্টিন লুথার কিং এবং আফ্রিকায় কালোদের অধিকারের জন্য নেলসেন ম্যান্ডেলা, তেমনি বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ত্রাণকর্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধুকে শারীরিকভাবে আর আমরা ফিরে পাব না। তাই শোকের মাসে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের বাকী সদস্যদের রূহের মাহফেরাত কামনা করছি এবং সেই সাথে দাবি জানাচ্ছি বিদেশে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর বাকী খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে অবিলম্বে রায় কার্যকরের।
বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তি ও খুনের দায় পরিশোধের জন্য আমাদের উচিত সব রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে তার কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে মনোনিবেশ করা। আজকের টগবগে তরুণরাই হবে স্বপ্ন পূরণের সেই সারথি।
লেখক : ফ্যাকাল্টি মেম্বার, অর্থনীতি বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন