আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রধান সমস্যা হলো সীমিত সম্পদ দিয়ে ব্যাপক অভাব মেটানো। ১৯৭১-পূর্ববর্তী সময়ে আমাদের সম্পদশালী সম্ভাবনাময় দেশটি পাকিস্তানিদের কালো থাবায় বিপন্ন হয়েছিল।স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া এ দেশটিকে বাসযোগ্য করে তোলা। আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় সম্পদ বাড়ার হার ছিল খুবই সীমিত। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষণজন্মা নেতৃত্বে আমরা আমাদের দেশকে শত্রুমুক্ত করতে পেরেছিলাম এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও আমরা তারই নেতৃত্বেই সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা হারাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা এ দেশে বাংলাদেশ নামের আড়ালে পাকিস্তানি এজেন্ডা বাস্তবায়নের নোংরা খেলার সূচনা করে। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ২১ বছর ইতিহাসবিকৃতির এক কুৎসিত অধ্যায় রচিত হয়েছে। যারা ইতিহাসের পাতা থেকে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান মুছে ফেলতে চেয়েছিল তারাই যে এই দেশটাকে পাকিস্তানি কায়দায় গিলে ফেলতে চেয়েছিল এ কথা সহজেই অনুমেয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি তাঁর নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসার পরে আমরা তরুণ প্রজন্ম প্রকৃত ইতিহাস জানার সুযোগ পাই এবং নানামুখী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি সোনার বাংলা গড়ার। এরপর ২০০১ সালে আবার নানামুখী নেতিবাচক কৌশলের মাধ্যমে খালেদা জিয়া ক্ষমতা দখল করার পরে এ দেশে ইতিহাসবিকৃতি এবং দখলদারিত্বের নেতৃত্ব কায়েম হয়।
২০০৯ সালে নানান প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে ক্ষমতায় আসেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার সরকার ধাবমান হন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে। যেখানে উন্নয়ন বলতে আমরা বুঝতাম শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সেখানে শেখ হাসিনা বাংলার মানুষকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছেন এবং যা আজ শুধু স্বপ্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বাস্তব।
শেখ হাসিনার সাথে খালেদা জিয়ার সরকারের একটি পার্থক্য দেখাই। তা হলো খালেদা জিয়া বিদ্যুতের খাম্বা দিয়েছেন গ্রামে গ্রামে আর সেই খাম্বায় বিদ্যুত পৌঁছে দিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০০১ সালের লোডশেডিং পরিস্থিতি এবং বর্তমান লোডশেডিং পরিস্থিতির কথা কখনো ভেবে দেখেছেন কি ? ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালের মাঝে যারা এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন তারা ভালো বলতে পারবেন। তখনকার ইংরেজি প্রথম পত্রে লোডশেডিং প্যারগ্রাফটা খুবই গুরুত্ব দিয়ে পড়ানো হতো বার্ষিক পরীক্ষার জন্য। ইংরেজি পপি গাইডের একটি লোডশেডিং প্যারাগ্রাফের প্রথম লাইনটা আমার এখনো মনে আছে ‘Loadshedding is a common phenomena in our country’। বলতে ভালো লাগে, লোডশেডিং এখন আর আমাদের কমন কোনো অবস্থা নয়। আর হয়তো তার কারণেই এখন কোনো পরীক্ষার জন্য কারো লোডশেডিং প্যারাগ্রাফ পড়তেও হয় না। ইতিহাসের পাতা থেকে লোডশেডিং হারিয়ে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী সব পদক্ষেপের কারণে। সফলতার সাথে একের পর এক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন তিনি। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম বিদ্যুৎ প্রকল্প বাগেহাটের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র । কিছু মানুষ সুন্দরবন রক্ষার দোহাই দিয়ে রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের বিরোধিতা করছেন। ২০ মিনিট বিদ্যুৎ না থাকলে যারা অকথ্য ভাষায় সরকারের সমালোচনা করেন, তারাই আবার এই বিদ্যুত প্রকল্পের সমালোচনা করছেন। তাদের মতে, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নাকি সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর।
সমালোচকরা কখনো ভেবে দেখেন না যে, সরকার মানুষের জন্যই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছেন। নিশ্চিতভাবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সুন্দরবন নিশ্চিতভাবে আমাদের সকলের সম্পদ। নিশ্চয় সরকার এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যা সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর। সুন্দরবনের ওপর এই প্রকল্পের কোন ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না।
প্রতি বছর মে ও জুন মাসের কিছু সময় ছাড়া সারাবছরই উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়। এই প্রকল্পে পৌনে তিন শ’ মিটার উচ্চতার চিমনি ব্যবহার করা হবে। সামান্য যেটুকু কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও বিভিন্ন গ্যাস বের হবে তা বাতাসের উচ্চতর স্তরে চলে যাবে। ফলে সুন্দরবনের ওপর কোনো রকম বিরূপ প্রভাব পড়বে না। অথচ সমালোচনাকারীরা মানুষকে প্রকল্প সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এলাকায় কর্মসংস্থান বাড়বে। মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি হবে। চিকিৎসা সুবিধাসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং এলাকার মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হবে। এলাকার দৃশ্যপট বদলে যাবে। এলাকার মানুষ তাদের ভাগ্য উন্নয়নে নিশ্চিতভাবে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন চায়।
আগামী ২০১৮ সালে এ কেন্দ্র থেকে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনা আনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১৫ সালে উৎপাদনে আসার কথা ছিল । কিন্তু নানা কারণে বিলম্বিত হয়। দুই দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ( পিডিবি) ও ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার লিমিটেডের (এনটিপিসি) উদ্যোগে গঠিত ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ কম্পানি (বিআইএফপিসি) বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে বছরে ৭০ লাখ টন কয়লার দরকার হবে। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত এ কয়লা বড় পুকুরিয়া থেকে মোংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রে আনা হবে ।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করার ফলে পরিবেশ দূষণের মাত্রা হবে সামান্য। বিদ্যুৎকেন্দ্রের সুপার আল্ট্রাক্রিটিকান প্রযুক্তিতে কেন্দ্রের দক্ষতা হবে ৪৫ ভাগের বেশি। অন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যা হয় সাধারণত ৩৭ থেকে ৩৮ ভাগ। একভাগ দক্ষতা বৃদ্ধি তিন ভাগ কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমায়। পরিবেশ রক্ষায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে এমকিউএম বা অটোমেটিক কোয়ালিটি ম্যনেজমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ছাই বা অ্যাশ ছড়াবে না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লির উচ্চতা হবে ২৫০ মিটার, যা কুতুব মিনারের চেয়ে তিনগুণ উঁচু। ফলে এতে সুন্দরবনের ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই এবং পরিবেশ দূষণও হবে কম।
তাই আসুন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে শুধু সরকারের সমালোচনার জন্য সমালোচনা না করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করি।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন